জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টুকুর দর সংশোধন ছাড়া গত বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত পুঁজিবাজার বলতে গেলে উড়ছে। এই সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানির দর বেড়েছে, কোনো কোনোটির ৩ থেকে ৪ গুণ বা ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়েছে।
এর মধ্যে অনন্য একটি উচ্চতায় পৌঁছল দেশের পুঁজিবাজার। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নতুন সূচক ডিএসইএক্স চালুর পর সূচকের অবস্থান এখন সবচেয়ে বেশি।
নিয়মিতই লেনদেন হচ্ছে দেড় হাজার কোটি থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার মধ্যে। একেক সময় একেক খাতে দর বৃদ্ধিতে এগোচ্ছে নানা খাত। সক্রিয় হচ্ছেন গত বহুজন, বাড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও।
২০১০ সালের মহাধসের পর নানান সময় একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পুঁজিবাজারে লেনদেনে চাঙাভাব দেখা দিলেও একটি বড় সময়ের জন্য চাঙাভাব এই প্রথম দেখা গেছে। আর এর পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নানান উদ্যোগ, বিশেষ করে বন্ধ কোম্পানি চালু, বেশ কিছু কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পাল্টে দেয়া, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করা, বন্ড মার্কেটকে চাঙা করার উদ্যোগ, আর বাজারের জন্য বড় আকারের একটি তহবিল গঠনের কারণে বাজার আরও ভালো হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
বিএসইসির প্রধান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামও এই আশার কথাই বলে আসছেন। তিনি বিনিয়োগকারীদের কিছু হলেই আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলছেন, এই আতঙ্কই নানান সময় বাজারে পতনের কারণ হয়।
তবে এত সব ইতিবাচকতার মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে রয়ে গেছে অস্বস্তি। যখন কোনো খাতের শেয়ারদর বাড়তে থাকে, তখন সেই খাতের কোম্পানিগুলোর দাম বাড়তে থাকে বাছবিচার ছাড়াই। লোকসানি, বন্ধ, উৎপাদন চালু নিয়ে কোনো আভাস নেই, এমন বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারদরও গত দুই মাসে দ্বিগুণ বা তিন গুণ হয়েছে।
উত্থান অব্যাহত থাকায় সাড়ে সাত বছর আগে চালু হওয়া ডিএসইএক্স সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আপ্লুত করেছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বিনিয়োগকারীদের এমন আচরণ নিয়েই শঙ্কিত। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া কোম্পানির শেয়ারদর কমে যেতে থাকলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে যেতে পারে আর সে ক্ষেত্রে লেনদেনের গতিও কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান আপাতত অর্জনটাকেই সামনে নিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, ‘এই যে ডিএসইএক্স সূচক সর্বোচ্চ অবস্থানে। এটি পুঁজিবাজারের জন্য বড় অর্জন।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগাকরীদের হতাশা ছিল, বিনিয়োগকারীরা আন্দোলনও করেছে। এই পুঁজিবাজার এখন বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগের আকর্ষণের মাধ্যম। তা না হলে সূচক আজকের অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না।’
পুঁজিবাজারের এই উচ্চতায় ওঠার পেছনে বিএসইসিকে ধন্যবাদও জানান রকিবুর। বলেন, ‘কমিশন যেভাবে কাজ করছে, তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে। আর এই আস্থার প্রতিফলনও বলা চলে আজকের পুঁজিবাজারের এই উচ্চতায় ওঠা।
‘এখন কোনো খাতের একক আধিপত্য নেই। সব খাতের শেয়ারের দর বাড়ছে। বিমা খাত নিয়ে আলোচনা থাকলেও এখন বস্ত্র খাতের শেয়ারের দর বেড়েছে। ব্যাংকের শেয়ারের দরও বেশ খানিকটা বেড়েছে। এখন আবার মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর বাড়ছে।
মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো চাঙা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলেও মনে করেন রকিবুর। বলেন, ‘আমার বক্তব্য হচ্ছে, নতুন বিনিয়োগকারীরা তারা যেন তাদের পুরো টাকা এনেই সরাসরি সেকেন্ডারি মাকেটে বিনিয়োগ না করে। সেকেন্ডারি মার্কেটে অর্ধেক টাকা আর মিউচ্যুয়াল ফান্ডে অর্ধেক টাকা বিনিয়োগ করা উচিত।
‘যারা নতুন তারা পুঁজিবাজার বুঝতে বুঝতে তাদের পুরো বিনিয়োগই হারিয়ে যায়। কিন্তু ফান্ডে বিনিয়োগ করলে টাকা হারাবে না। বছর শেষে কিছু না কিছু রিটার্ন পাওয়া যাবে। কারণ, এগুলো পুঁজিবাজারের সবচেয়ে দক্ষ বিনিয়োগকারীরা পরিচালনা করে।’
পঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ অবশ্য উচ্ছ্বসিতের পাশাপাশি কিছুটা উদ্বিগ্নও। এর কারণ, দুর্বল কোম্পানির দাপট।
গত কয়েক মাসে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ফ্যামিলি টেক্স, অ্যাপোলো ইস্পাত, তুং হাই নিটিং, জেনারেশন নেক্সট, সাফকো স্পিনিং, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ফাস ফাইনান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ফাইনান্স, ফার্স্ট ফিনান্স, ফারইস্ট ফিনান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের মতো বন্ধ, লোকসানি কোম্পানির শেয়ার দর কয়েক গুণ হয়েছে। এর পেছনে কী যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না এই অর্থনীতিবিদ।
এসব দুর্বল কোম্পানির বাজার মূলধন বেশি না হলেও এগুলোতে যদি বেশি মুনাফা পাওয়া যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে আগ্রহী হয় না। আর এটি বছরের পর বছর চললে একপর্যায়ে বাজারের জন্য দুর্বলতা তৈরি হয়।
আবু আহমেদ
আবু আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিনই সূচক বাড়ছে। লেনদেন বাড়ছে। বিনিয়োগ হচ্ছে বলেই শেয়ারের দর বাড়ছে। আর এ জন্য সূচকে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কিন্তু লেনদেনে যেভাবে দুর্বল কোম্পানির দাপট দেখা যাচ্ছে, তাতে গতিশীল পুঁজিবাজার ধরে রাখা কঠিন। তবে পুঁজিবাজার বর্তমানে যেভাবে যাচ্ছে, তা ধরে রাখতে হলে দুর্বল কোম্পানির দাপট কমাতে হবে।’
মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘সূচকের এই অবস্থার পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন ছিল আস্থা। নতুন কমিশন অনেক ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। যার প্রতিফলনে আস্থা তৈরি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এটি ধরে রাখার জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। বিনিয়োগকারীরা যে বিনিয়োগ করেছে, সেটি যেন কোনো আতঙ্কের কারণে বের হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’