পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের সুকুক বন্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কমতি নেই। বেসরকারি খাতে দেশের প্রথম ইসলামি শরীয়াহভিত্তিক এ বন্ড নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। অনেকে অংক কষছেন এ বিনিয়োগে কতটা লাভ, ঝুঁকির মাত্রাই বা কী। আবার একেবারে নতুন ধরনের বন্ড হওয়ায় সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন অনেকে।
তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড যে প্রাক্কলন দিয়েছে, তা যদি সত্যিই বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ হবে লাভজনক। বিশেষ করে যারা সুদি বন্ডে বিনিয়োগ করতে চান না, তাদের জন্য এটি হতে পারে সুযোগ। এটি সামগ্রিকভাবে বন্ড বাজারকে যেমন শক্তিশালী করবে, তেমনি ভূমিকা রাখবে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ২৩ জুন ৫ বছর মেয়াদি সুকুক বন্ড ছেড়ে তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন দেয় বেক্সিমকো লিমিটেডকে। বন্ডটির নাম বেক্সিমকো লিমিটেড গ্রিন সুকুক আল ইস্তিসনা। এটি অংশগ্রহণমূলক ও রূপান্তরযোগ্য বন্ড, যা দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হবে।
বন্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত টাকার একটা অংশ কোম্পানিটি তাদের বস্ত্রখাতের ব্যবসা সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করবে। বাকি টাকা ব্যয় হবে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে।
এরই মধ্যে প্রস্তাবিত সুকুকের ট্রাস্টি নিবন্ধন সনদ ও অনুমোদিত ট্রাস্ট ডিডসহ সাবস্ক্রিপশন চুক্তি বিএসইসিতে জমা দেয়া হয়েছে। যার ভিত্তিতে টাকা সংগ্রহের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি। আগামী ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হবে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের প্রক্রিয়া।
সুকুক কী এবং কেন
সুকুক হলো ইসলামিক শরিয়াহ নীতিমালা মেনে পরিচালিত বন্ড বা আর্থিক পণ্য। প্রচলতি বন্ডের সুদের পরিমাণ নির্ধারিত থাকে, কিন্তু তার বিপরীতে কোনো সম্পদের ব্যাকআপ থাকে না। তবে সুকুক নিদির্ষ্ট সম্পদ বা প্রকল্পের বিপরীতে গঠিত হয়। ওই সম্পদ ও প্রকল্পের আয়ই আনুপাতিক হারে পেয়ে থাকেন সুকুক ইউনিটধারীরা। সুদমুক্ত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী দুই ট্রিলিয়ন ডলারের ইসলামি আথিক সম্পদের ৭৩ ভাগই ব্যাংকিং সম্পদ, যার ১৭ শতাংশই সুকুক।
ইসলামিক আর্থিক সেবা শিল্প স্থিতিশীলতা-আইএফএসবির ২০২০ সালের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক সুকুক স্থিতির পরিমাণ ছিল ৫৪৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। আগামী ৫ বছরে এর আকার দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারত্ব প্রায় ২৫ শতাংশের মতো হলেও, ইসলামি আর্থিক পণ্যের অভাবে তাদের বিপুল সম্পদ এতদিন বিনিয়োগ বঞ্চিত ছিলো। এমন বাস্তবতায় ২০১৯ সালে সুকুক বন্ডের নীতিমালা অনুমোদন দেয় সরকার।
এরপরই সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পে অরথায়নে সুকক বন্ডের মাধ্যমে ৮ হাজার কোটি টাকা তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের ডিসেম্বর পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সরকার বনিয়োগ সুকুকের প্রথম নিলাম হয়। যেখানে ৪ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ১৫ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার, যা চারগুণেরও বেশি। আর এতেই বোঝা যায় দেশে সুকুকের মতো বন্ডের বিপুল চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই নিজেদের প্রকল্প বাস্তবায়নে সুকুক বন্ড নিয়ে আসছে বেক্সিমকো।
কোথা থেকে টাকা আসবে
মূলত তিন ভাবে বেক্সিমকো সুকক বন্ডের টাকা তোলা হবে। মোট তহবিলের ৫০ শতাংশ বা এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আসবে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। ৭৫০ কোটি টাকা নেয়া হবে বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে। আর বাকি ৭৫০ কোটি টাকা তোলা হবে জনসাধারণের কাছ থেকে আইপিওর মাধ্যমে। সুকুকটির প্রতিটি ইউনিটের অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। আর ন্যূনতম লট হবে ৫০টি ইউনিটে। সে হিসাবে একজন বিনিয়োগকারীকে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
কোথায় বিনিয়োগ হবে
বেক্সিমকোর সুকুক বন্ডের টাকার একটা বড় অংশ একই গ্রুপের মালিকাধীন তিস্তা সোলার লিমিটেড-টিসিএলে বিনিয়োগ হবে। গাইবান্ধা জেলায় অবস্থিত ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন সৌর বিদ্যুত প্রকল্পটি এককভাবে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড়। এছাড়া পঞ্চগড়ে ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার করোতোয়া সোলার লিমিটেড-কেএসএলে বিনিয়োগ হবে কিছু অংশ। বাকি টাকা বিনিয়োগ হবে বেক্সিমকোর টেক্সটাইলে।
বেক্সিমকো টেক্সটাইল দেশের অন্যতম বড় সবুজ শিল্পপার্ক। জ্বালানি সাশ্রয়ী অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে এ শিল্পপার্ককে। এ কারণে বন্ডটিকে দেশের প্রথম গ্রিন বন্ড আখ্যা দিচ্ছে বিএসইসিও।
বিনিয়োগকারীরা কী পাবেন
সুকুক বন্ডের বিনিয়োগকারীরা চাইলে তাদের ইউনিটগুলো বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে রূপান্তর করে নিতে পারবেন। প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে এটি করা যাবে। এজন্য নির্ধারিত রেকড ডেটের আগের ২০ দিনে বেক্সিমকো লিলিমেটের শেয়ারের দামের যে ভারিত গড় হবে, তার ২৫ শতাংশ কমে এ শেয়ার পাবেন সুকুকধারীরা।
অর্থাৎ উল্লিখিত সময়ে বেক্সিমকোর শেয়ারের গড় দাম ১০০ টাকা হলে, রূপান্তর মূল্য হবে ৭৫ টাকা। তার মানে এক হাজার টাকার সুকুক বন্ডের বিপরীতে মিলবে ১৩ দশমিক ৩৩ টি শেয়ার। কেউ প্রথম বছর রূপান্তর না করলেও, পরবর্তী বছরে এ সুযোগ নিতে পারবে। কেউ একেবারেই রূপান্তর না করলে, মেয়াদ শেষে নিয়ামানুযায়ী বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত পাবেন।
মুনাফা কেমন হবে
বেক্সিমকোর প্রাক্কলন বলছে, সুকুক বন্ডটির ভিত্তি মুনাফা হবে কমপক্ষে ৯ শতাংশ। এর বাইরে সুকুকটি অংশগ্রহণমূলক হওয়ায় বেক্সিমকো লিমিটেডের ঘোষিত লভ্যাংশের সঙ্গে সুকুকের মুনাফার যে ফারাক থাকবে, তার ১০ শতাংশ অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে যুক্ত হবে। বেক্সিমকো লিমিটেড ২০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করলে, সুকুকের নিশ্চিত মুনাফার সঙ্গে ফারাক হয় ১১ শতাংশ। এর ১০ শতাংশ হলো ১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার মানে সুকুকধারীরা পাবেন ১০ দশমিক শতাংশ মুনাফা।
একই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় বছরে ১০ দশমিক ৬০ এবং তৃতীয় বছরে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ মুনাফা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সুকুকের যেই অংশ বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে রূপান্তরিত হবে, সেটুকুর ক্যাপিটাল গেইন যোগ করলে মুনাফার হার আরও বাড়বে।
কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, বাজার মূল্যের চেয়ে ২৫ শতাংশ কমে সুকুকধারীরা শেয়ার পাওয়ায় প্রতিবছর এক্ষেত্রে ইল্ড দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশের মতো। আর ফেয়ার ভেল্যু গেইন হবে চার শতাংশ। সবমিলিয়ে প্রথম বছরেই একজন বিনিয়োগকারী ২০ দশমিক ৭৭ শতাংশের মতো মুনাফা ঘরে তুলতে পারেন। দ্বিতীয় বছর থেকে রূপান্তরিত সাধারণ শেয়ারের লভ্যাংশ যুক্ত হওয়ায় এর পরিমাণ হতে পারে ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তৃতীয় বছরে ২৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
নিশ্চয়তা কী
গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠান টিএসএল, কেএসএল ও বেক্সিমকো টেক্সটাইলের মেশিনারিজ ও ভবিষ্যত আয়কে সম্পদ ধরে সুকুক বন্ডটি ছাড়া হচ্ছে। এর মধ্যে টিএসএল এক হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা, কেএসএলে তিনশ ১০ কোটি এবং ৮০২ কোটি টাকা বেক্সিমকো বস্ত্র প্রকল্পে বিনিয়োগ হবে। এসব প্রকল্প সমপরিমাণ সম্পদের ব্যাকআপ দেবে। যেই সম্পদের পুরোটাই নিষ্কংটক।
সরকারের সঙ্গে ২০ বছরের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি থাকায় ভবিষ্যতের আয় সুরক্ষিত। এছাড়া সৌর বিদ্যুত প্রকল্পের মালপত্র আমদানিতে শুল্ক ও করমুক্ত সুবিধা রয়েছে। ১৫ বছরের জন্য রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক করমুক্ত সুবিধাও। ফলে এ দুই প্রকল্প নিরঙ্কুশ আয়ের নিশ্চয়তা প্রায় শতভাগ।
বন্ডটির সঙ্গে আর কারা যুক্ত
বন্ডটির উদ্যোক্তা বেক্সিমকো লিমিটেড। ইসুয়ার বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক ট্রাস্ট। ট্রাস্টি হিসেবে থাকছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবি। ট্রাস্ট ম্যানেজারও থাকছে আইসিবি। ইস্যু উপদেষ্টা ও ব্যবস্থাপক সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্স লিমিটেড। সহযোগী ব্যবস্থাপক অগ্রণী ইক্যুয়িটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। অবলেখনকারী প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ইক্যুয়িটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, এবি ইনভেস্টমেন্ট ও এআইবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড।