এক দশকের হতাশা কাটিয়ে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে ব্যাপক মুনাফার আভাস, সম্পদমূল্য বৃদ্ধি আর সম্পদের তুলনায় বেশিরভাগের দাম কম থাকার পরিপ্রেক্ষিতে এই খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়ে উঠেছেন।
ঈদের ছুটির আগে যে দুই দিন বাজারে লেনদেন চলতে তার প্রথম দিন এই খাতেই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি চাঙাভাব। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে যেসব খাতে, তার মধ্যে একটি ছিল এই খাত।
চাঙাভাব দেখা গেছে ঘুমিয়ে থাকা জ্বালানি খাতেও। শেয়ারের দাম বাড়ার পাশাপাশি লেনদেনেও দেখা গেছে গতি।
তবে সবচেয়ে বেশি শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে লভ্যাংশের অপেক্ষায় থাকা প্রকৌশল খাতে। বিপরীতে আগ্রহ হারিয়ে দামও হারাচ্ছে বিমা খাত, ব্যাংক নিয়ে হতাশা দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই, মাটিতে নেমেছে উড়তে থাকা বস্ত্র খাতও।
এর বিপরীতে সবচেয়ে বড় খবর হলো, ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি চালুর পর সাড়ে সাত বছরের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছাল ডিএসইএক্স সূচক।
২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর সূচকের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৩৩৬ পয়েন্ট। নানা সময় চাঙাভাব দেখা দিলেও সেই সূচক কখনও অতিক্রম করতে পারেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে গত মে মাসে ছয় হাজার পয়েন্টে উঠার পর সেখানে টিকে থাকতে এক মাস ধরে যে মনস্তাত্তিক লড়াই, সেটিতে জয় আসার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
বেলা ২ টা ২৬ মিনিটে ৬ হাজার ৩৩৭ পয়েন্ট অতিক্রম করার পর লেনদেনের শেষ সময়ে তা বাড়ে আরও। দিন শেষ হয় ৬ হাজার ৩৬৫ পয়েন্টে।
২৮ পয়েন্ট বাড়লেই ইতিহাস হবে, এমন অপেক্ষায় থাকা পুঁজিবাজারে সূচক বেড়েছে আগের দিনের চেয়ে ৫৭ পয়েন্ট। এর মধ্য দিয়ে ডিএসইএক্স সূচক ইতিহাসের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছল।
এখন ডিএসইএক্স চালুর আগে ২০১১ সালের ৩ আগস্ট ডিএসই সূচক ৬ হাজার ৩৮৯ পয়েন্ট পরবর্তী সর্বোচ্চ ধাপ।
ডিএসইএক্স সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান
সূচক আর ২৮ পয়েন্ট বাড়লে রেকর্ড হবে, এমন বাস্তবতায় রোববারের লেনদেন নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তুমুল আগ্রহ ছিল। তবে সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর এক ঘণ্টা পর ১১টা ৯ মিনিটে তাদের মধ্যে বিরক্তি ধরে লেনদেনে জটিলতায়।
ডিএসইর সার্ভার জটিলতায় লেনদেন বন্ধ থাকে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট। পরে লেনদেন নির্ধারিত সময় বেলা আড়াইটার পর আরও এক ঘণ্টা চলে।
কারিগরি ত্রুটির কারণে রোববার পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট
সোয়া এক ঘণ্টা বিরতির পর লেনদেন আবার শুরু হলে সূচক বাড়তে থাকে। বেলা একটা ৩ মিনিটে ৬ হাজার ৩২২ পয়েন্ট থেকে বেড়ে এক পর্যায়ে ৬ হাজার ৩৭১ পয়েন্ট গিয়ে পৌঁছে। শেষ ৫ মিনিটে কিছু কমলেও সেটিতে উৎফুল্ল হয় বিনিয়োগকারীরা।
পুঁজিবাজারের এই ছুটে চলা শুরু ২০২০ সালের জুলাই থেকে। করোনার কারণে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির পর ৫ জুলাই বাজার শুরুর দিন সূচক ছিল ৩৯৮১ পয়েন্ট। সেখান থেকে প্রায় দুই হাজার পয়েন্ট বাড়ে এক টাকা।
গত ১৪ জানুয়ারি সূচক উঠে ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্টে। তবে এর পর দুই মাসের অস্থিরতায় সূচক গত ৪ এপ্রিল এক পর্যায়ে নেমে আসে ৫ হাজার ৮৮ পয়েন্টে।
৫ এপ্রিল লকডাউন শুরুর দিন পুঁজিবাজারে শুরু হয় দ্বিতীয় উত্থান। এক পর্যায়ে ৩৯ মাসের মধ্যে সূচক প্রথমবারের মতো ৬ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে গত ৩০ মে। এরপর এক মাস উঠানামা করতে থাকে। প্রায়ই ৬ হাজার থেকে নিচে নেমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় পুঁজিবাজারে।
তবে ৩০ জুন ৬ হাজার ১৫০ পয়েন্টে উঠার পর নিশ্চিত হয় যে, ছয় হাজার পয়েন্ট নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে মনস্তাত্তিক লড়াই তৈরি হয়েছিল, তাতে জয় হয়েছে। এরপর থেকে আবার বাড়তে থাকে সূচক।
গত বৃহস্পতিবার ৬ হাজার ৩০৭ পয়েন্ট হওয়ার পর ডিএসইএক্স এর রেকর্ড হয় কি না, তা নিয়ে তৈরি হয় আগ্রহ।
ডিএসইএক্স চালুর আগে যে সূচক ছিল, সেই ডিএসই সূচক কিন্তু এখনকার অবস্থানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এক পর্যায়ে। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সেই সূচক ছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্ট। পরদিন থেকেই শুরু হয় এক দশক ধরে চলমান ধস।
মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ব্যাপক আগ্রহ
তালিকাভুক্ত সব মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা এর আগেও দেখা গেছে পুঁজিবাজারে। তবে রোববার যেটি হয়েছে, সেটি এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
এই খাতে আগের দিন ১৪০ কোটি টাকা লেনদেনই অনেককে অবাক করেছিল। তবে এটি আরও বেড়ে এবার ছাড়িয়েছে দুইশ কোটির ঘর। দিন শেষে লেনদেন দাঁড়িয়েছে ২০৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এরচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে কেবল প্রকৌশল খাতে।
ফান্ডের মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলোর দাম বেড়েছে। তবে কমেনি একটিও।
সর্বাধিক দর বৃদ্ধি পাওয়া ২০টি কোম্পানির মধ্যে মিউচ্যুয়াল ফান্ড না থাকলেও ৩৬টি ফান্ডের মধ্যে অনেকগুলোর দাম বেড়েছে দিনে যত বাড়া সম্ভব তার কাছাকাছি।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৭.৩১ শতাংশ, এরপর পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৭.২৪ শতাংশ।
দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইসের ফান্ডগুলো ছিল বেশ এগিয়ে। এই দুইটার পাশাপাশি এই কোম্পানির অন্য ফান্ডগুলোর মধ্যে ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৬.৫৭ শতাংশ, ইবিএল ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৬.৫২ শতাংশ, এফবিএফআইএফের ৫.৭৯ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৫.৩৩ শতাংশ, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৫.৩৩ শতাংশ, এবি ব্যাংক ফার্মাট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৫.১৯ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ২.১৫ শতাংশ দর বেড়েছে।
অন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর ফান্ডের মধ্যে দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে দম।
মাস কয়েক আগে হতাশা থাকলেও
১০টি ফান্ড এখন অভিহিত মূল্য ১০ টাকার বেশি ১০টি কাছাকাছি চলে এসেছে। একটি ভালো দিনেই তা ছাড়িয়ে যেতে পারে ১০ টাকা। আর সবচেয়ে কম দাম এখন এফবিএফআইএফের ৭ টাকা ৩০ পয়সা।
ফান্ড নিয়ে এই আগ্রহের কারণ, এগুলোর আকর্ষণীয় লভ্যাংশের সম্ভাবনা।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের পর থেকে এই খাতটিও ছিল ঘুমিয়ে। তবে এবার ৯ মাসে আকর্ষণীয় মুনাফা আর অতালিকাভুক্ত বিভিন্ন ফান্ডের লভ্যাংশ ঘোষণার পর পুঁজিবাজারেরগুলোও ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করবে বলে আভাস মিলেছে। এই অবস্থায় এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। আর চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দাম।
বিদ্যুৎ-জ্বালানির জাগার আভাস
পুঁজিবাজারে উত্থানের প্রভাব পড়েনি একেবারেই পড়েনি এই খাতে। তবে রোববারের লেনদেন আশাবাদী করেছে এই খাতের শেয়ারধারীদেরকে। অথচ লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুম চলে এসেছে আর বেশিরভাগ কোম্পানিই গত বছরের চেয়ে বেশি আয় করেছে বলেই তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদনে দেখা যায়। করোনাকালেও কোম্পানিগুলোর ব্যবসার খুব বেশি ক্ষতি হয়েছে, এমন নয়।
এই খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে দাম কমেছে কেবল দুটির, বেড়েছে বাকি সবগুলোর।
কেবল দাম বেড়েছে এমন নয়, এই খাতের লেনদেনও জাগাচ্ছে আশা। ১০৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে এই একটি খাতে।
এই খাতে সবচেয়ে বেশি ৯.৭২ শতাংশ বেড়েছে নতুন তালিকাভুক্ত বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ারের দাম। তবে হাতবদলের সংখ্যা নগণ্য। এই দামে মাত্রা ৪ হাজার ৪১০টি শেয়ার বিক্রি করতে রাজি হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
এ ছাড়া ৮.৫৩ শতাংশ দাম বেড়েছে সরকারি কোম্পানি পদ্মা অয়েলের। বাকিগুলোর দাম বৃদ্ধির হার শতকরা হিসেবে খুব একটা বেশি নয়।
অন্যান্য খাতের কী চিত্র
সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া প্রকৌশল খাতে ১৫টি কোম্পানির দাম কমার বিপরীতে বেড়েছে ২৭টির। হাতবদল হয়েছে ২৩৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
গত মাসের শেষ দিকে উড়তে থাকা বস্ত্র খাত আরও খানিকটা দর হারিয়েছে। ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে দর হারিয়েছে ৪২টি। দর ধরে রাখতে পেরেছে কেবল একটি। বেড়েছে বাকি ১৫টির দাম। সবচেয়ে বেশি দর হারানো ৫টি কোম্পানির সবগুলো এই একটি খাতের।
এই খাতে হাতবদল হয়েছে ১৬৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও পাঁচশ কোটি টাকার আশেপাশে ছিল।
আরও হতাশ করেছে বিমা খাত। এক মাস ধরেই পতনের মধ্যে থাকা এই খাতটি সূচকের রেকর্ড করার দিন দাম বেড়েছে কেবল ৯টির। একটির লেনদেন ছিল স্থগিত, কমেছে বাকি ৪১টির দর।
হাতবদল হয়েছে মোট ১২৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যা মাস দুয়েক আগে সাতশ কোটি টাকারও বেশি ছিল, এক দিন তা নয়শ কোটির ঘরও পেরিয়ে যায়।
চাঙাভাব দেখা গেছে ওষুধ ও রসায়ন খাতেও। ৩১টি কোম্পানির মধ্যে একটির লেনদেন স্থগিত দীর্ঘদিন ধরেই। বাকিগুলোর মধ্যে ১০টির দাম কমার বিপরীতে বেড়েছে ২০টির। হাতবদল হয়েছে মোট ১৭৪ কোটি ৯ লাখ টাকা।
আর হতাশার বৃত্তে থাকা ব্যাংক খাত কোনো আশা দেখাতে পারেনি। যদিও দিনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই খাতে দাম বাড়ার সংখ্যা ছিল খুবই কম, তবু শেষ বেলায় কিছুটা হলেও বেড়েছে।
৩১টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ১৬টির, কমেছে ৮টির, একটির লেনদেন ছিল স্থগিত, বাকি ৬টির দাম ছিল অপরিবর্তিত।
এই খাতে হাতবদল হয়েছে ৯১ কোটি ৮২ লাখ টাকা, যা সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে কমগুলোর একটি।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫৭.৭৬ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৬৫ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ২০ দশমিক ০২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজা ৩৭৯ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ৩১ দশমিক ১২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩০৬ পয়েন্টে।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২১০টির, দর কমেছে ১৫০টি, দর পাল্টায়নি ১৩টির। মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই আগের দিনের তুলনায় ৬০ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৭৯ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে মোট ৭১ কোটি টাকা।