দিনভর ওঠানামার পর শেষ বেলায় ক্রয় চাপে পুঁজিবাজারে সূচক বেড়েছে বটে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা যে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক, সেটি উঠে আসছে লেনদেনের চিত্রে।
গত মাসে দুই হাজার কোটি বা তার চেয়ে বেশি লেনদেনই ছিল এক নিয়মিত ঘটনা। সেখানে এখন দেড় হাজার কোটির আশপাশেই থাকছে তা।
সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার, যা আগের দিনের চেয়ে বেশ কম। বুধবার পতনের বাজারে লেনদেন ছিল ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ নিয়ে সতর্কতার দিনটি বিমা খাতের শেয়ারধারীদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। কারণ, এই খাতের শেয়ারের দাম ক্রমাগত পড়ছিলই। তবে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। এই খাতের ৫১টি কোম্পানির মধ্য ৩৭টিরই দর বেড়েছে।
তবে এদিন চাঙা ছিল মূলত ওষুধ ও জ্বালানি খাতের শেয়ার দর।
কেপিসিএলের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার চালুর আবেদন অনুমোদনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও প্রজ্ঞাপন আসছে না। এই পরিস্থিতিতে চাঙা পুঁজিবাজারে বলতে গেলে গোটা খাতই ঝিমাচ্ছিল।
তবে আজ এই খাতের ২২টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ১৬টির। তবে কেপিসিএল সেই ঝিমুনিতেই, বাড়েওনি, কমেওনি।
ওষুধ ও রসায়ন খাতে মাঝেমধ্যে ঝিলিক দেখা গেলেও অর্থবছর শেষ হওয়ায় এখন লভ্যাংশের মৌসুমেও সেভাবে জাগছিল না।
এই খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে একটির লেনদেন স্থগিত দীর্ঘদিন ধরে। বাকিগুলোর মধ্যে কমেছে তিনটির। আর বেড়েছে বাকি ২৭টির দর।
আকর্ষণীয় লভ্যাংশ ঘোষণা করা ও চলতি বছর অর্ধবার্ষিকীতে প্রত্যাশা ছাড়িয়ে মুনাফা করা ব্যাংক খাত মন্দা অবস্থা থেকে বের হতে পারেনি এদিনও। ৩১টি কোম্পানির মধ্যে ৬টির দাম বেড়েছে ১০ পয়সা করে। ৯টির দাম ছিল অপরিবর্তিত। আর কমেছে বাকি ১৬টির। দাম বৃদ্ধির হার যেমন খুবই কম, তেমনি যেগুলোর দাম কমেছে, সেগুলোর পতনের হারও বেশি নয়। চারটি ছাড়া বাকিগুলোর দাম কমেছে ১০ থেকে ২০ পয়সা করে। আর সবচেয়ে বেশি ৭০ পয়সা দর হারিয়েছে এনআরবিসি ব্যাংক।
শাটডাউনের সপ্তাহে টানা চাঙাভাব থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাত কিছুটা দর হারিয়েছে। ইউনিটপ্রতি ১০ থেকে ৩০ পয়সার মধ্যে কমেছে বেশির ভাগের।
আলোচিত অন্য খাত বস্ত্রের বেশির ভাগ কোম্পানি দর হারিয়েছে। লেনদেনও দুই শ কোটি টাকার আশপাশে নেমে এসেছে।
শাটডাউনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় লেনদেন হয়েছে এদিন। সোম থেকে বুধবার পর্যন্ত লেনদেন সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত হলেও আজ হয়েছে ২টা পর্যন্ত।
বিনিয়োগে আবারও চাঙা বিমা
গত কয়েক দিন ধরে হারিয়ে যাওয়া বিমা কোম্পানি তার দাপট আবারও দেখাল বৃহস্পতিবার। লেনদেনে বিমা খাতের ৫১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩৭টির। দর কমেছে ১২টির। আর দর পাল্টায়নি ২টির।
এরই সঙ্গে আবারও দর বৃদ্ধির বেশিরভাগ স্থান দখলে নিয়েছে বিমা। নতুন লেনদেনে আসা সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পাঁচ দিন লেনদেনে প্রতিদিনই বেড়েছে দিনে যতটুকু বাড়া সম্ভব।
এই কোম্পানি থেকেই নতুন নিয়মে আনুপাতিকহারে শেয়ার বণ্টন শুরু হয়েছে। প্রতি বৈধ আবেদনকারী ১০ টাকার আবেদনে পেয়েছেন ১৭টি শেয়ার। ফলে প্রাপ্ত শেয়ার কম হওয়ায় কেউই শেয়ার বিক্রি করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। প্রতিদিনই প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি শেয়ার ক্রয়ের আবেদন থাকলেও বিক্রি করছেন না কেউ।
বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৫৮ শতাংশ। হাতবদল হয়েছে ৯০৭টি শেয়ার, যার বাজার মূল্য ছিল ১৫ হাজার টাকা।
এরপরেই ছিল ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, যার শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। একই সঙ্গে শেয়ার প্রতি দর ১১৮ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১২৫ টাকা ৭০ পয়সা।
স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। একই সঙ্গে শেয়ার প্রতি দর ৬৯ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৪ টাকা।
তবে বিমা খাতের কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে সাড়ে তিন শতাংশ পর্যন্ত। তালিকাভুক্ত রিলায়েন্স ও সন্ধানী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। প্রভাতি ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স এবং প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ১ দশমিক ৩১ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
প্রকৌশল খাতেও দর বাড়ার হাতছানি
সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে চমক দেখিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাত। এখাতে তালিকাভুক্ত ৪২টি কোম্পানির মধ্যে সিঙ্গারবিডি ছাড়া বাকি ৪১টি কোম্পানির অর্থবছর শেষ হয়েছে জুন মাসে।
সম্প্রতি এই খাতের কয়েকটি কোম্পানি তাদের তৃতীয় প্রান্তিক প্রকাশের পর শেয়ারের দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
বৃহস্পতিবার লেনদেনে দিনের সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানির মধ্যে চারটি ছিল প্রকৌশল খাতের। এ খাতের লেনদেন হওয়া ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২৪টির। দর কমেছে ১৬টির। দর পাল্টায়নি দুটির।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির কোম্পানিগুলোর মধ্যে আজিজ পাইপের শেয়ার দর বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৭ টাকা ৮০ পয়সা। লেনদেনে হাতবদল হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৫৫টি শেয়ার, যার বাজার মূল্য ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
আনোয়ার গ্যালভালাইজিং লিমিটেডের শেয়ার দর শতকরা হিসেবে বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দর ২০৭ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ২২৪ টাকা ৪০ পয়সা। কোম্পানিটির ৫ লাখ ৯৫ হাজার শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যার বাজার মূল্য ছিল ১২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
মুন্নু অ্যাগ্রো অ্যান্ড জেনারেল মেশিনাররিজ লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দর ৫৬৭ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬১০ টাকা ৩০ পয়সা।
বাংলাদেশ অটোস লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৮১ হাজার ৯৬৯টি, যার বাজারমূল্য ১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
অনাগ্রহে মন্দা ব্যাংকে
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে ফান্ডামেন্টাল বা ভালো খাত হিসেবে ব্যাংক খাতের সুনাম রয়েছে। কিন্ত এ খাতের শেয়ারের দরই সবচেয়ে বেশি মন্দায় থাকে। বিশেষ করে কোনো কোম্পানি যখন লভ্যাংশ ঘোষণার পর রেকর্ড ডেটের পর প্রথম লেনদেন হয় তখন সেই কোম্পানির শেয়ারের কোনো সার্কিট ব্রেকার থাকে না। ফলে ওই কোম্পানির শেয়ার দর বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে কোনো বিধি নিষেধ থাকে না।
ট্রাস্ট ব্যাংক তার শেয়ারধারীদের ২০২০ সালের জন্য ১০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যার রেকর্ড ডেট ছিল ৭ জুলাই। ওই দিন ব্যাংকটির লেনদেন বন্ধ ছিল। পরদিন ৮ জুলাই ব্যাংকটির শেয়ারের কোনো সার্কিট ব্রেকার ছিল না। কিন্ত তারপরও ব্যাংকটির শেয়ার দর বাড়ার চেয়ে বরং কমেছে ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
লেনদেন ব্যাংকটির ৩৮ টাকা ৮০ পয়সার শেয়ার কমে হয়েছে ৩৪ টাকা ৪০ পয়সা।
গত কয়েকদিন ধরে দর বৃদ্ধির তালিকায় থাকা ব্যাংক খাতের সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংক আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার দর বৃহস্পতিবার কমেছে ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। শেয়ার প্রতি দর ৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৪ টাকা ৭০ পয়সা।
প্রাইম ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এবি ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে দশমিক ৯৪ শতাংশ।
এদিন ব্যাংক খাতের লেনদেন হওয়া ৩১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ছয়টির। দর কমেছে ১৬টির। দর পাল্টায়নি নয়টির। এ খাতের মোট লেনদেন হয়েছে ৮০ কোটি টাকা।
অন্যান্য খাতের লেনদেন
বস্ত্র খাতের লেনদেন হওয়া ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে ১৭টি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে। চারটির দর পাল্টায়নি। বাকি ৩৭টি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার দিনের সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ দর বৃদ্ধি পেয়েছে তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল লিমিটেডের। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর ৫৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৪ টাকা ৯০ পয়সা।
এছাড়া এইচআর টেক্সটাইল লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। শেয়ার প্রতি দর ৫০ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা ৬০ পয়সা।
নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে তালিকাভুক্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৃহস্পতিবার দর বেড়েছে মাত্র পাঁচটির। দর পাল্টায়নি একটির। বাকি ১৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর কমেছে। এদিন নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মোট লেনদেন হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের তালিকাভুক্ত ২২টি কোম্পানির মধ্যে বৃহস্পতিবার লেনদেনে দর বেড়েছে ১৬টির, কমেছে চারটির। বাকি দুটি কোম্পানির শেয়ার দর পাল্টায়নি।
গত দুই কার্যদিবসে দর বৃদ্ধিতে চমক দেখিয়ে বৃহস্পতিবার অনেকটাই মন্থর ছিল মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো। এদিন ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র দুটির। কমেছে ২৭টির। আর বাকি আটটির দর পাল্টায়নি।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৩৫ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১২১ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ১৪ দশমিক ০৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১৪ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ১৬ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৪৮ পয়েন্টে।
ডিএসইতে লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৯১টির, কমেছে ১৫৫টির। দর পাল্টায়নি ২৮টির।
বৃহস্পতিবার মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই আগের দিনের তুলনায় ১২০ দশমিক শূন্য ৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে মোট ৭৪ কোটি টাকা।