প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেপিয়ারকে কেউ কেউ বলে থাকেন নিউজিল্যান্ডের স্বর্গভূমি। বলাটা অতি স্বাভাবিক। প্রকৃতি যেন নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছে এই নেপিয়ারকে গড়ে তুলতে। একটা সময় একপ্রকার ধ্বংসই হয়ে যাওয়া শহরটিকে ফের মাথা তুলে দাঁড় করাতে প্রকৃতি যেন নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে। আর তাতেই সময়ের পরিক্রমায় নেপিয়ার পরিণত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের স্বর্গভূমিতে।
এই নেপিয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের একটি মিল রয়েছে। শহরটি ভূমিকম্পের ফলে পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। আর বাংলাদেশ দলেরও একই দশা লাগাতার ব্যর্থতার কারণে। সে কারণে প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েই যেন নিজেদের সেই দৈন্যদশা কাটানোর মিশনে কোমর বেঁধে নামেন টাইগার ক্রিকেটাররা। নিজেদের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে আরও একবার রচনা করেন ঐতিহাসিক এক উপাখ্যানের।
ওয়ানডে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ লিখেছিল রূপকথার এক জয়ের গল্প। সেই গল্পের নতুন অধ্যায় এই নেপিয়ারেই রচনা করলেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। প্রথমবারের মতো টাইগাররা পেয়েছেন নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ক্রিকেটের শর্টার ফরম্যাটে জয়ের এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সেই জয়ের মূল কারিগর ছিলেন বোলাররা। শর্টার ফরম্যাটে এসেও বল হাতে ওয়ানডের সেই দাপট ধরে রাখেন শরিফুল-মাহেদীরা। আর সেই দাপটের আগুনে ম্যাচের শুরু থেকেই পুড়তে হয় কিউই ব্যাটারদের।
নেপিয়ারে শেষ ওয়ানডের সময় বাংলাদেশের পিছু নেওয়া সৌভাগ্য পিছু ছাড়েনি টি-টোয়েন্টিতে এসেও। টসভাগ্য কিংবা কন্ডিশন, সবকিছুই পক্ষে ছিল বাংলাদেশের। উইকেটের কথাতেই আসা যাক। নেপিয়ারের উইকেটে স্পিনাররা খুব একটা সুবিধা পান না সাধারণত। কিন্তু ম্যাচের দিন উইকেটও যেন পণ করে বসেছিল- যে করেই হোক জেতাতে হবে লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের। আর সে কারণে নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে ভোজবাজির মতো নিজেকে বদলে ফেলে সহায়ক হয়ে ওঠে টাইগার স্পিনারদের জন্য।
স্পিনাররা যেমন দাপুটে ছিলেন, পেসাররাও ছিলেন একই রূপে। বদলে যাওয়া উইকেটের ফায়দা আসতে শুরু করে ম্যাচের শুরু থেকেই।
প্রথম ওভারেই কিউই শিবিরে আঘাত হানেন অফস্পিনার শেখ মাহেদী, তুলে নেন আগ্রাসী ব্যাটার টিম সেইফার্টের উইকেট। এর পরের ওভারে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটারদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে উপনীত হন বাঁহাতি পেসার শরীফুল ইসলাম, দ্বিতীয় ওভারে তুলে নেন জোড়া উইকেট। দলীয় ১ রানের মধ্যেই ৩ উইকেট নেই মিচেল স্যান্টনারের দলের।
এরপর ড্যারেল মিচেল কিংবা মার্ক চ্যাপম্যান, এই দুই ব্যাটার নিজেদের ইনিংস বড় করার চেষ্টা করলেও টাইগার বোলারদের বোলিং দৃঢ়তায় তা সম্ভব হয়নি। যে কারণে দলীয় ৫০ রানের মধ্যেই ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে নিউজিল্যান্ড। এরপর তাদের হয়ে হাল ধরেন দুই বাঁহাতি ব্যাটার জিমি নিশাম এবং মিচেল স্যান্টনার। তাদের দুজনের ৪১ রানের জুটিতে সাময়িক ধাক্কার চাপ কিছুটা হলেও সামাল দেন কিউইরা। নিশাম আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাট চালাতে থাকলেও স্যান্টনার বেশ দেখেশুনেই খেলছিলেন।
কিন্তু দলীয় ৯১ রানে শরীফুল ইসলামের বলে সৌম্য সরকারের এক অসাধারণ ক্যাচে আউট হতে হয়ে তাকে। প্যাভিলিয়নে ফেরত যাওয়ার আগে স্যান্টনার খেলেন ২৩ রানের এক গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। এরপর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠা ব্যাটার জিমি নিশামও। দলীয় ১১০ রানে তাকে ফেরান মুস্তাফিজুর রহমান। এরপর শেষের দিকে টেইলএন্ডার অ্যাডাম মিলনের ১২ বলে ১৬ রানের ইনিংসের ওপর ভিত্তি করে ১৩৪ রানের লড়াকু পুঁজি পায় নিউজিল্যান্ড। বাংলাদেশের হয়ে এ দিন সবচেয়ে সফল বোলার ছিলেন পেসার শরীফুল, নিয়েছেন ৩ উইকেট।
১৩৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা তেমন ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। দলীয় ১৩ রানেই অ্যাডাম মিলনের বলে ক্যাচআউট হন ওপেনার রনি তালুকদার (১০)। শুরুটা ভালো করলেও এ দিন নিজের ইনিংস বড় করতে পারেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত (১৯)। দলীয় ৩৮ রানে নিশামের বলে ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন তিনি। শান্তর মতো এ দিন একই পরিণতি হয়েছে সৌম্য সরকার (২২) আর তাওহীদ হৃদয়ের (১৯)। তারা দুজন সেট হয়েও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। সৌম্য-হৃদয়ের বিদায়ের পর বাঁহাতি ব্যাটার আফিফ হোসেন প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন মাত্র ১ রান করে। যার ফলে দলীয় ৯৭ রানের মধ্যেই ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে টিম টাইগার্স। কিন্তু এ দিন বাকি ব্যাটারদের আশা-যাওয়ার মিছিলে উইকেটের আরেক প্রান্তে ঠিকই টিকে ছিলেন ওপেনার লিটন দাস (৪২*)। শেষের ৩ ওভারে যখন বাংলাদেশের জয়ের জন্য প্রয়োজন ২৪ রান, তখন বেন সিয়ার্সের বলে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়েও ১৪ রান তোলেন তিনি। যে কারণে শেষের দুই ওভারে বাংলাদেশের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র ১০ রান, যা লিটনকে সঙ্গ দেওয়া ব্যাটার মাহেদী একাই (১৯*) একটি চার এবং ছক্কা মেরে পূরণ করে দেন। যার ফলে ৯ বল এবং ৫ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় টাইগাররা।