১৯৩১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। সকালটা ছিল নিউজিল্যান্ডের নেপিয়ারবাসীর জন্য বিভীষিকার। কেন না সেই সকালেই ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল শহরটা। সময় পরিক্রমায় শহরটি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় একটা সময়। লেখে ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এক উপাখ্যান।
সেই নেপিয়ারেই ৯২ বছর পর এসে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখল বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলকে বিধ্বস্ত করে জন্ম দিল এক রূপকথার গল্পের।
সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ৯ উইকেটে। আর তাতেই লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা মিটিয়েছে ১৬ বছরের আক্ষেপ। প্রথমবারের মতো পেয়েছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদেরই বধের স্বাদ।
১৯ বারের চেষ্টায় এই সফলতার মুখ দেখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে এড়িয়েছে হোয়াইটওয়াশও। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পেয়েছে নিজেদের সবচেয়ে বড় জয়।
নেপিয়ারে এমন ইতিহাস গড়া জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বোলারদের। নতুন বলে শরিফুল ইসলাম-তানজিম সাকিবরা রীতিমতো আগুন ঝরালেন। তাদের সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছেন কিউই ব্যাটাররা। তিনটি করে উইকেট নিয়ে তানজিম হাসান, সৌম্য সরকার ও শরিফুল ইসলাম ৯৮ রানে থামিয়ে দেন স্বাগতিকদের। বাংলাদেশের বিপক্ষে এটিই নিউজিল্যান্ডের সর্বনিম্ন রানের নজির।
স্বল্প রান নিয়ে লড়াইটা একদমই করতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। নাজমুল হোসেন শান্ত ও এনামুল হকের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে কেবল ১ উইকেট হারিয়ে ২০৯ বল বাকি থাকতেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় সফরকারীরা।
ইতিহাস গড়া এই ম্যাচে টাইগাররা গড়েছে বেশ কিছু অনন্য রেকর্ড। ওয়ানডেতে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো শতরানের নিচে তাদের আটকে দেয়ার রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। টাইগার পেসারদের বোলিং তোপে মাত্র ৯৮ রানেই থেমে যায় কিউইদের ইনিংসের চাকা।
প্রতিপক্ষকে শতরানের নিচে আটকে দেয়ার তৃতীয় নজির এটি বাংলাদেশের। এর আগে কেবল জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শতরানের নিচে আটকে দিয়েছিল টাইগাররা।
বাংলাদেশের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের এটি সবচেয়ে কম স্কোর। আগের সর্বনিম্ন স্কোর ছিল ১৬২ রান। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার কোনো ম্যাচে ১০ উইকেটই নিলেন বাংলাদেশের পেসাররা। কিউইদের বিপক্ষে এই ম্যাচে তানজিম হাসান, শরীফুল ইসলাম ও সৌম্য সরকার নিয়েছেন ৩টি করে উইকেট। একটি উইকেট ঝুলিতে পোরেন মোস্তাফিজুর রহমান।
এর আগে চলতি বছরেরই মার্চে, সিলেটে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন হাসান মাহমুদ (৫), তাসকিন আহমেদ (৩) ও ইবাদত হোসেন (২)।
১৪তম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে ৫০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন টাইগার পেসার শরীফুল ইসলাম। এ ক্ষেত্রে তিনি তৃতীয় দ্রুততম। তার লেগেছে ৩৩ ম্যাচ। ২৭ ম্যাচে ৫০ উইকেট নেয়ার বাংলাদেশের রেকর্ডটি মোস্তাফিজুর রহমানের, যিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন আবদুর রাজ্জাকের ৩২ ম্যাচের রেকর্ড। ২০৯ বল হাতে রেখে রোববার নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ওয়ানডেতে এটি তাদের তৃতীয় সর্বোচ্চ বল হাতে রেখে জেতার রেকর্ড।
রেকর্ড ব্যবধানে পাওয়া সান্ত্বনার জয়ের পর বেশ আত্মতৃপ্ত মনোভাব ব্যক্ত করেছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। এই জয় তাদের আসন্ন টি-টোয়েন্টি সিরিজেও আশা দেখাবে বলে মনে করছেন তিনি।
শান্ত বলেন, ‘এই ম্যাচ আমাদের অনেক আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি আলাদা ফরম্যাট। আমরা ওভাবেই তার জন্য পরিকল্পনা করব। আমরা কিছু জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা করেছি। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে, কিছুদিনের ভেতরই টি-টোয়েন্টি খেলতে হবে।’
আক্ষেপও রয়েছে তার। আর সেই আক্ষেপ হলো সিরিজ হাতছাড়া হওয়ার।
শান্ত বলেন, ‘যদি ইতিহাস দেখেন, অবশ্যই আমরা গর্ব করার মতো পারফর্ম করেছি। একটা ম্যাচ জিততে পেরেছি। আমাকে যদি ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলব- সিরিজ জিততে এসেছিলাম। প্রথম ম্যাচটায় একটু আনলাকি ছিলাম বৃষ্টির কারণে। আমাদের বোলিং অপশনগুলো আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এক ম্যাচ জিততে পেরেও অবশ্য খুশি। তবে সিরিজ জিততে পারলে আরও ভালো লাগত।’
এদিকে টাইগারদের পেস আগুনে পুড়ে খাক হওয়া কিউই দলপতি টম লেইথামের মুখে ছিল কেবলই টাইগার পেসারদের স্তুতি। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমরা প্রত্যাশার চেয়েও বাজে খেলেছি...। বাংলাদেশ (বোলাররা) মুভমেন্ট পেয়েছে এবং ভালো জায়গায় বল করেছে। তাদের প্রশংসা করতেই হবে।’