ফেসবুকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে সারা দেশের আলোচিত আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের স্বপ্ন দিন দিন পিছিয়ে পড়া ফুটবলকে এগিয়ে নেয়া। সে কারণে নিজ এলকায় গড়ে তুলেছেন ‘ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল অ্যাকাডেমি’ নামে একটি ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীরা যে শুধু ফুটবল প্রশিক্ষণই পায় তা নয়। দরিদ্র প্রশিক্ষণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ অ্যাকাডেমি থেকে দেয়া হচ্ছে আর্থিক সহযোগিতাও। সেই সঙ্গে খেলাধুলার পাশাপাশি দরিদ্র ফুটবলারদের দেয়া হচ্ছে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে।
নিজের অ্যাকাডেমির ফুটবলারদের যেমন অনেক দূর এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন ব্যারিস্টার সুমনের, তেমনি এই অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেয়া তৃণমূলের ফুটবলারও স্বপ্ন দেখে একদিন জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বজয়ের।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলের পাইপলাইনে খেলছে সুমন অ্যাকাডেমির ফুটবলাররা।
এ নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘ফুটবল হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের প্রথম প্রেম। বাংলাদেশে এমন কোনো লোক পাবেন না যে ফুটবলে লাথি দেয়নি। ফুটবলের যে উন্মাদনা, সেই উন্মাদনাকে এক্কেবারে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আমার চাওয়া আগুনটাকে আবার জ্বালানো। বিষয় হলো কাউকে না কাউকে তো জ্বলতে হবে। তাহলে তো আপনি অন্যকে আলোকিত করতে পারবেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে পোড়ার জিনিসটা না-হয় আমিই হই। আমার যত অর্জন আছে, তা দিয়ে আমার এলাকার মানুষ ও বাংলাদেশের ফুটবলটারে সামনের দিকে নিয়ে যাইতে চাই।
‘ফুটবল দিয়ে আপনি সারা পৃথিবীতে মান কামাতে পারবেন, টাকা দিয়ে না কিন্তু। সেনেগালের মতো সামান্য সামান্য দেশ আজ ফুটবলের মাধ্যমে সারা বিশ্বে পরিচিত।’
ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল অ্যাকাডেমি যাত্রা শুরু করে ২০২০ সালের শুরুতে করোনাকালীন লকডাউনের সময়। এর পর থেকে তৃণমূলের সম্ভাবনাময় ফুটবলারদের তুলে আনার চেষ্টা করছে অ্যাকাডেমিটি। বর্তমানে তিনটি গ্রুপে (এ, বি ও সি) অ্যাকাডেমির খেলোয়াড়ের সংখ্যা দেড় শ।
প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে চুনারুঘাট ডিসিপি মাঠে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাদের। এর মধ্যে প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সি গ্রুপের ৬০-৭০ জন খুদে ফুটবলার প্রশিক্ষণে নামে। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রয়েছেন একজন কোচ ও একজন সহকারি কোচ। এ ছাড়া বিকেলে বি ও সি গ্রুপের খেলোয়াড়রা প্রশিক্ষণ নেন।
এসব সম্ভাবনাময় ফুটবলারদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য মাঝেমধ্যে ঢাকা থেকে জাতীয় পর্যায়ের কোচদের এনেও প্রশিক্ষণ করানো হয়।ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল অ্যাকাডেমিতে অনেক চা-শ্রমিক শিশুরাও নিয়মিত প্রশিক্ষণে আসে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা দরিদ্র পরিবারের শিশুদের অনেক সময় যাতায়াত ভাড়া দেয়া হয় অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে। এ ছাড়া জার্সি, বুটসহ প্রশিক্ষণের জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম বিনা মূল্যে দেয়া হয়।
এ নিয়ে সুমন বলেন, ‘‘মানুষ তৃণমূলেই হয়। যোগ্যতা তৃণমূলেই হয়। তৃণমূলের বাইরে গিয়ে আসল মানুষ পাবেন না। তৃণমূল থেকে যারা ওঠে আসে তাদের ‘রিয়েল ট্যালেন্ট’ বলে। অ্যাকাডেমিতে যারা আসবে তাদের শুধু ফুটবলার বানানো আমার উদ্দেশ্য না। তাদের একটা সফল মানুষ বানাতে চাই। যারা নিজের পরিবার, এলাকা ও দেশটিকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে।’’
ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী জেলার বাইরের ফুটবলাররাও। তাদের জন্য মাঝেমধ্যে এক-দুই মাসের ক্যাম্প করা হয়। প্রতি ক্যাম্পে ৩০ জন ফুটবলার অংশগ্রহণ করতে পারে। এ সময় থাকা-খাওয়াসহ অ্যাকাডেমি থেকে যাবতীয় খরচ বহন করা হয়।অ্যাকাডেমির নিয়মিত কোচ হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর সাবেক সহকারী কোচ আজিজুল ইসলাম। তাকে প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়।
এ ছাড়া প্রতি মাসে অ্যাকাডেমির জন্য ব্যয় হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, যা সম্পূর্ণটাই ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন তার নিজস্ব তহবিল থেকে দিয়ে থাকেন।
অ্যাকাডেমির খেলোয়াড় কাউছার আহমেদ বলে, ‘আমি হবিগঞ্জ জেলা দলের ১১ জনের একজন। ব্যারিস্টার সুমন অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষণ ভিন্ন। কারণ এখানে নিয়মিত ভালো একজন কোচ প্রশিক্ষণ দেন। এ ছাড়া প্রায় সময় দেশসেরা কোচদের এনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, যা অনেক বড় খেলোয়াড়রাও পান না।’
অসহায় খেলোয়াড়দের পাশে ব্যারিস্টার সুমন অ্যাকাডেমিখুদে ফুটবলার ইমন বুনার্জি। বয়স ১২ বছর। চুনারুঘাট উপজেলার পার্কুল বাগানের চা-শ্রমিকের সন্তান ইমনের মা-বাবা নেই। ফুটবলের প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ ও অসাধারণ পারফরম্যান্স ব্যারিস্টার সুমনকে মুগ্ধ করেছে। ইমনকে নিয়ে আগামীতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন ব্যারিস্টার সুমন।
শুধু ইমন নয়, নিজের অ্যাকাডেমির ছয় খুদে ফুটবলারকে নিজের বাসায় রেখে সহায়তা দিচ্ছেন সুমন।
ইমন বলেন, ‘ব্যারিস্টার সুমন নিজের ছেলের মতো লালন-পালন করছেন। যখন যা প্রয়োজন- বলতে হয় না, নিজেই এনে দেন। আমি চাই আমার প্রতি স্যারের যে বিশ্বাস ও স্বপ্ন রয়েছে, আমি যেন তা পূরণ করতে পারি। আমি একদিন বাংলাদেশের জাতীয় দলে খেলে স্যারের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই।’
এরই মধ্যে অ্যাকাডেমি থেকে অসহায় খেলোয়াড়দের জীবিকা নির্বাহ ও দূরের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণে আসার জন্য দেয়া হয়েছে পাঁচটি মোটরসাইকেল, চারটি রিকশা, এক ইজিবাইক ও নগদ টাকা।
নিজের অ্যাকাডেমির খেলোয়াড়দের সঙ্গে ব্যারিস্টার সুমন। ফাইল ছবিঅ্যাকাডেমির সফলতাব্যারিস্টার সুমন অ্যাকাডেমি থেকে চারজন খেলোয়াড় অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে খেলছে। একজন বাংলাদেশ এলিট ক্যাম্পে অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলছে। এ ছাড়া অনূর্ধ্ব-১৭ দলে হাবিবুর রহমান, মধু মিয়া ও অনিক দেববর্মণ সুমন নামে তিনজন খেলছে।
সুমন অ্যাকাডেমি কোনো টুর্নামেন্টে অংশ নেয় না। প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত মাত্র একটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে। শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়।
এ ব্যাপারে ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল অ্যাকাডেমির ম্যানেজার সাজিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবলকে এগিয়ে নেয়া। আমরা বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যাচ্ছি। হাজার হাজার মানুষ আমাদের এই অগ্রযাত্রার সঙ্গে তারা যুক্ত হচ্ছে, খেলা দেখতে আসছে।’
অ্যাকাডেমির নিয়মিত কোচ আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ছেলেদের নিয়ে বেশ আশাবাদী। ব্যারিস্টার সুমন সাহেব তৃণমূলের ফুটবলারদের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেটি বিরল। তবে এর জন্য শুধু সুমন সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না।খেলোয়াড়দেরও চেষ্টা থাকতে হবে ভালো কিছু করার। আশা করছি, একদিন অ্যাকাডেমি থেকে আরও কয়েকজন জাতীয় দলের হয়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে।’