কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের রোসনা বেগমের সংসার চলত দিনমজুরির টাকায়। করোনার কারণে দেশজুড়ে চলা বিধিনিষেধে কাজ না থাকায় পরিবার নিয়ে পড়েন দুর্ভোগে।
করোনা শুরুর পর গত বছর লকডাউনের শুরুতে রোসনার মতো নিম্নবিত্তদের মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করে সরকার। এর মধ্যে ছিল মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ‘নগদের’ মাধ্যমে অর্থসহায়তা। খবর পেয়ে সেই তালিকায় নাম লেখান রোসনা।
নিউজবাংলাকে রোসনা জানিয়েছেন, গত বছর থেকে এ পর্যন্ত দুবার তার নগদ অ্যাকাউন্টে আড়াই হাজার করে পাঁচ হাজার টাকা এসেছে। চলতি বছরের ১৬ জুলাই তৃতীয় দফায় নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা আসার এসএমএস পান তিনি। তখনই নগদ অ্যাকাউন্ট চেক করেন। তবে সেখানে কোনো টাকা আসেনি।
অথচ এসএমএসে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, ‘চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে সাময়িক অসুবিধা মোকাবিলার লক্ষ্যে আপনার পরিবারের জন্য ২৫০০ টাকা সহায়তা প্রদান করা হলো। ঈদ মোবারক। প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’।
নিউজবাংলার প্রতিবেদককে এই বার্তা তিনি দেখিয়েছেন।
রোসনা বলেন, ‘ঈদের আগে ১৬ জুলাই দুপুরে আমার ফোনে ২ হাজার ৫০০ টাকা আসার একটি মেসেজ আসে। আমি দোকানে গিয়ে ফোন দেখালে দোকানদার বলেন, অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। সেই টাকা এখন পর্যন্ত আমি পাইনি।’
মোবাইলে টাকা দেয়ার মেসেজ দেয়া হলেও অ্যাকাউন্টে টাকা আসেনি অনেকের। ছবি: নিউজবাংলা
শুধু রোসনা নন, এমন অভিযোগ ইউনিয়নের আরও কয়েকজন উপকারভোগীর। কেউ বলছেন, তারা একাধিকবার নগদে সহায়তা পেয়েছেন। কেউ আবার অভিযোগ করেছেন, মেসেজ এলেও তাদের নগদ অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা জমা হয়নি।
অর্চনা নামের এক নারী বলেন, ‘সরকার হামাক আড়াই হাজার করি টাকা দিছে বইলে মোবাইলে মেসেজ আসলেও একবারও সেই টাকা পাইনি।’
উপকারভোগী গণেশ চন্দ্র সেনের ছেলে সজীব কুমার সেন বলেন, ‘সরকার যখন প্রথম এই টাকা দিল, তখনও কোনো এসএমএস আসেনি। অনেকে দ্বিতীয়বার টাকা পাওয়া শুরু করল, তখন আমার বাবার ফোনে শুধু মেসেজ আসে, কিন্তু কোনো টাকা আসেনি।’
একই ইউনিয়নের আলতাফ হোসেন জানান, তালিকায় নাম থাকায় প্রথম দফায় আড়াই হাজার টাকা পান তিনি। এরপর আর কোনো টাকা আসেনি।
উপকারভোগীরা বলছেন, তারা জানেন না একেকজনের জন্য কত টাকা করে বরাদ্দ; সেই টাকা কয় দফায় তারা পাবেন। তাদের ধারণা, কোনো চক্র সরকারের পাঠানো টাকাগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে।
বড়ভিটা ইউনিয়নের হরিদাশ মোহন্ত বলেন, ‘আমি একবার টাকা পেয়েছি। মেম্বার, চেয়ারম্যানের হাত দিয়া টাকা দিলে ওমরা চুরি করে। এই বলি সরকার পদক্ষেপ নিলে ফোনের মাধ্যমে টাকা বিতরণ করব।
‘আমরা তাই ভাবছি। এখন অফিস খাচ্ছে না, কে খাচ্ছে হামার জানার উপায় নাই, যেহেতু হামরা নিরীহ মানুষ।’
মেসেজ এলেও টাকা না আসার বিষয়টি স্বীকার করেছেন উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বি এম আবুল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে প্রায় ১ হাজার ২০০ নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা দেয়া হয়েছে। সেই তালিকার অনেকেই তিনবার, দুবার, একবার করে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া করোনার সহায়তা পেয়েছেন। কেউ কেউ এসএমএস পেলেও টাকা পাননি। বিষয়টি সরকারের খতিয়ে দেখা দরকার।’
এ বিষয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেয়া করোনার মানবিক সহায়তার জন্য আমরা জেলা, উপজেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তালিকা প্রণয়নে সহযোগিতা করেছি। এই কাজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং আইসিটি বিভাগ সম্পন্ন করেছে। তবে পরে কে টাকা পেল, কে পেল না, এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো নথি নেই। জানাও নেই।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। এই অর্থসহায়তা সরাসরি সরকারের অর্থ বিভাগ থেকে সুবিধাভোগীদের নগদ অ্যাকাউন্টে যায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের কারও কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখা হবে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯ উপজেলার প্রায় ৯০ হাজার নিম্নবিত্ত মানুষের তালিকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন নম্বরসহ নানা তথ্যে অসংগতি থাকায় বাদ পড়েছেন ৬ হাজার ৬৩৩ জন।
বাকি ৮৩ হাজার ৩৬৭ জনের মধ্যে ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টে টাকা পেয়েছেন ৬৬ হাজার ৭৪৮ জন।