করোনা সংক্রমণের কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আবাসিক হল ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাসে এখন সুনসান নীরবতা।
আবাসিক শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ছাড়া ক্যাম্পাসে দেখা মেলে না কারোই। এ কারণে বিপদে পড়েছে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করা কুকুর-বিড়াল।
আবাসিক হলগুলোর শিক্ষার্থীদের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়েই জীবন বাঁচত এই অবলা প্রাণীগুলোর। আবার অনেকে নিজেদের খাবার ভাগাভাগি করত এদের সঙ্গে।
খাবারের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় খাবারের উৎস একবারে বন্ধ এসব প্রাণীর। বেশির ভাগ সময় কুকুর-বিড়ালগুলোকে বিভিন্ন অনুষদের সামনে নিথর পড়ে থাকতে দেখা যায়।
শুধু কুকুর-বিড়াল নয়, ক্ষুধার কারণে আশপাশের জঙ্গল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কে বেরিয়ে আসছে শিয়াল, গুইসাপ, বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণী।
এই অভুক্ত প্রাণীগুলোর পাশে অনেকটা দেবদূতের মতো দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক আলী আজম। ক্যাম্পাসে বিচরণ করা এসব ক্ষুধার্ত প্রাণীকে প্রতিদিন নিয়ম করে খাবার দিচ্ছেন তিনি।
প্রথমে নিজের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কুকুরগুলোর জন্য খাবার রান্না শুরু করেন অধ্যাপক আলী আজম। পরে গভীর রাত পর্যন্ত সেই খাবার পৌঁছে দেন ক্যাম্পাসের প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিচরণ করা কুকুরগুলোর কাছে।
কুকুরদের খাবার দিতে গিয়ে আলী আজমের নজরে আসে অভুক্ত শিয়ালদের বিষয়টিও। কুকুরদের দেয়া খাবারের ঘ্রাণে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে শিয়ালগুলো।
এরপর থেকে তিনি শিয়ালদের জন্যও বাড়তি খাবারের ব্যবস্থা করেন। কুকুরের সঙ্গে শিয়ালদেরও খাবার দিতে থাকেন তিনি। এখন এই শিয়াল-কুকুরগুলো রাতে খাবার নিয়ে আসা গাড়িটি দেখলেই ছুটে আসে। জড়ো হয়ে দাঁড়ায় আলী আজমের পাশে।
অধ্যাপক আলী আজমকে দেখে এখন অনেক শিক্ষক ও কর্মচারীরাও এগিয়ে এসেছেন অভুক্ত প্রাণীগুলোকে খাবার দিতে।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমানের কোয়ার্টারের সামনে খাবারের জন্য জড়ো হয় বিড়াল ও গুইসাপ। প্রতিদিন বাজার থেকে পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া মাছ কিনে এনে এদের খেতে দেন এই শিক্ষক।
এ ছাড়া বিভিন্ন আবাসিক হলের নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের খাবারের কিছুটা অংশ এসব অবলা প্রাণীদের বিলিয়ে দেন।
অধ্যাপক আলী আজম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাপানে আমি দীর্ঘ ১৪ বছর থেকেছি। সেখান থেকেই আমার ভেতর চেঞ্জটা (পরিবর্তন) আসে। জাপানে যেটা দেখেছি, তারা প্রতিটি জীবজন্তুকে ভেতর থেকে দেখে। সেই ধারণা থেকে আমি প্রাণীদের জন্য অতীতেও কিছু করেছি।
‘এই করোনার সময়ে যখন ২০২০ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়, আমি যে হলের প্রভোস্ট, তখন ওই খানে বেশ কিছু কুকুর নরমালি আসত। তাদের চোখের দিকে যখন আমি তাকালাম, তখন মনে হলো তারা খুব ক্ষুধার্ত। ওই দিন থেকেই স্থির করেছিলাম, যতটুকু পারি আমার সাধ্যমতো তাদের কিছু রান্না করে খাওয়াব। সেখান থেকেই শুরু। সেই থেকে আস্তে আস্তে কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের সংখ্যা বেড়ে গেছে।’
ওই শিক্ষক বলেন, ‘আমি যেহেতু একা মানুষ, আমার পক্ষে তো সব এরিয়া কাভার করা সম্ভব না। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র থেকে উপাচার্জের বাসভবন হয়ে জয়বাংলা গেট পর্যন্ত একটা জোন করেছি। এই এলাকায় যত জীবজন্তু আছে, প্রতিদিন রাতে আমি এদের খাবার দেই।’
প্রাণীদের খাবার তৈরির কাজে নিয়োজিত শহীদ সালাম-বরকত হলের বাবুর্চি আবদুর রহমান বলেন, ‘হল বন্ধ হওয়ায় আমাদের রান্নার কাজ নাই। তবে স্যারের বাসায় শিয়াল-কুকুরদের জন্য খাবার রান্না করি। প্রতিদিন মুরগির গিলা, কলিজা, পাখনা, পা এসব বাজার থেকে কিনে আনি। পরে সে গুলা তরকারির মতো রান্না করা হয়। এরপর গরম ভাতের মধ্যে এই তরকারি মিশাইয়া এক ধরনের খাবার তৈরি শেষে ঠাণ্ডা করা হয়। পরে রাতে ড্রাইভারকে নিয়ে স্যার নিজে জীবজন্তুগুলাকে খাওয়ায়ে আসেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের নিরাপত্তাকর্মী জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাদের হলে অনেক বিড়াল ও কুকুর থাকত। করোনার সময় হল বন্ধ হওয়ায় কুকুর-বিড়ালগুলা খাবারের অভাবে ছোটাছুটি করে। তখন আমাগো হলের প্রভোস্ট স্যার নিজে বিড়াল আর গুইসাপগুলারে তার কোয়ার্টারের সামনে খাওয়ান। আমরাও আমাগো আনা খাবার মইধ্যে মইধ্যে ওগো দেই।’
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের শুরু থেকে বিড়ালগুলো আমার বাসার সামনে জড়ো হয়ে ডাকতে থাকত। একটা গুইসাপও মাঝে মাঝে রাস্তায় উঠে শুয়ে থাকত। তখন বিষয়টা আমার নজরে আসে। এরপর থেকেই ওদের জন্য বাজার থেকে পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া মাছ কিনে আনি, তারপর ওদের খাওয়াই।’