২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশের মূল মঞ্চ যে ট্রাকের ওপর তৈরি করা হয়েছিল, সেই ট্রাকটির চালক ছিলেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। তার ওপর নির্দেশনা ছিল, সমাবেশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন ট্রাক ছেড়ে কোথাও না যান। যে মুহূর্তে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়, তখনও ট্রাকে নিজের আসনেই বসা ছিলেন তিনি।
নিউজবাংলাকে তিনি তার সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার গাড়িটা ছিল তালতলার এক বসের। সেই বস আবার আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। আমি সেখানেই চাকরি করতাম। আমি যে গাড়িটা চালাতাম, সেটা ছিল নতুন। সেটাই দেয়া হয়েছিল মঞ্চ তৈরি করার জন্য। আমি তালতলা থেকে ১১টায় গাড়ি নিয়ে খেজুরবাগান মোড় থেকে কিছু ফার্নিচার তুলি। এটা নিয়ে পার্টি অফিসের সামনে গিয়েছি।
‘সেগুলো নামিয়ে গাড়িটার ওপর মঞ্চ বানানো হয়। পরে পুলিশ, ডিবি আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বারবার চেক করে। আমার গাড়িতে রং করা হয়েছিল, তার চক পাউডার ছিল। পরে এটা পাওয়ার পর ফেলে দিতে বলে। আমি ফেলে দিই। আধুনিক যন্ত্র দিয়ে চেক করল। এরপর আমরা দুপুরে খাওয়াদাওয়া করলাম। আমাদের পার্টির লোকেরা বলল, আপনাকে স্ট্যান্ডবাই থাকতে হবে। তো আমি থাকলাম।’
সারা দেশে একযোগে জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগ জনসভার আয়োজন করে। সেদিন বিকেলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালে গ্রেনেড হামলা হয়।
আওয়ামী লীগের সমাবেশে সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালে গ্রেনেড হামলা শুরু হলে নেতাকর্মীরা ট্রাকের ওপর মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনার সুরক্ষা নিশ্চিত করেন৷ ছবি: সংগৃহীত
ভয়াবহ এ হামলায় ২৪ জন নিহত এবং দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হন। হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী আইভি রহমান ছিলেন, যিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী।
হামলার সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে ট্রাকচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মিটিং শুরু হলো, অন্য নেতারা বক্তব্য দিলেন। সবার শেষে প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা) উঠলেন। বক্তব্য শেষ পর্যায়েই শুরু হলো বোম মারা।
‘প্রথম বোমটা ফোটেনি। ওটা গাড়ির ডালায় লেগে নিচে পড়ে গেল। পরেরটা আমার গাড়ির ডান পাশে যেখানে তেলের ট্যাংক থাকে সেটা নিয়ে পড়ল। এই বোমটাই আইভি রহমানের গায়ে পড়ে।
‘আমি গাড়ির মধ্যে সিটেই শুয়ে পড়লাম। তখন ছিটাগুলো আমার গায়ে পড়ল। আমার ঠোঁটে পড়েছে, দাড়ির ভেতরে পড়েছে, কোমরে পড়েছে, পায়ে পড়েছে। পরে আমি ট্রাক খুলে নামলাম লাফ দিয়ে। তখন আরও একটা বোম মেরেছে। সেগুলো সবই আমার কোমরে পড়েছে।’
হামলায় গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মহিলা আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি আইভি রহমান। ফাইল ছবি
এই ট্রাকচালকের মতে, সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে যেন কেয়ামত নেমে এসেছিল। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনা যে দেখেনি, সে কল্পনাও করতে পারবে না। যখন আমি দেখলাম, দেখি মানুষগুলো সব শুয়ে আছে, কেউ কাত হয়ে, কেউ সোজা হয়ে কেউ উপুড় হয়ে।
‘কার দিকে কে চায়, সবাই কান্নাকাটি করছে, কেউ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। মানুষের রক্ত, জুতা, শরীরের অংশ….. কারও হাত পড়ে আছে, কারও পা পড়ে আছে। যে দেখেছে, সেই শুধু এটা অনুভব করতে পারবে। প্রচুর বোম আর গুলির আওয়াজ। অনেক শব্দ হচ্ছিল। তখন কেমন করে নিজেরে বাঁচাব, এটা নিয়েই ছিলাম।’
শরীরে স্প্লিন্টারের আঘাত নিয়েই কোনো রকমে হাসপাতালে পৌঁছান ট্রাকচালক রফিকুল। সেখানে গিয়েও দেখেন বিভীষিকাময় দৃশ্য। তিনি বলেন, ‘কোনো রকমে পাশের মার্কেটে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখি গেট আটকে দিয়েছে। পরে দেখি মানুষজন ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তাদের সিএনজিতে করে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে।
‘আমি একটা সিএনজির সাইডে দাঁড়িয়ে ঢাকা মেডিক্যালে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি কার চিকিৎসা কে করে! অনেক মানুষ, রক্তাক্ত। পরে সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিলাম। আমার শরীরে মোট ১১টা স্প্লিন্টার ছিল। এর মধ্যে ১০টা বের করা গেছে, কিন্তু এখনো একটা শরীরেই আছে। সেটা মাঝেমধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা দেয়।’
এ ঘটনার পর অনেকে অনেক সহযোগিতা পেলেও তার কিছুই পাননি এই ট্রাকচালক, যদিও প্রায়ই মামলার সাক্ষী হতে তাকে ছুটতে হয় আদালত প্রাঙ্গণে।