২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৪ বছর পর বিচারিক আদালত থেকে রায় পাওয়া গেছে, তাতে দণ্ডিত ১৫ জনের সাজা কার্যকর অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
এদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ফরিদপুরের দুই ভাই মুরছালিন ও মুত্তাকিনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য আছে। বাকিদের মধ্যে ৫ থেকে ৬ জনের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা যায়, অন্যদের বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই।
এই রায় অবশ্য এখনও উচ্চ আদালত অনুমোদন করেনি। তবে দণ্ডিত ৪৯ জনের মধ্যে ৩৪ জন হয় কারাগারে, নয় জামিনে আছেন। বাকি ১৫ জন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দেশের বাইরে অথবা অন্য কোথাও আত্মগোপনে থাকা এই ১৫ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনা বা গ্রেপ্তারের উদ্যোগে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই।
এই রায় দেয়ার সময় মোট ১৮ জন পলাতক ছিলেন। তবে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইকবাল হোসেনকে দিয়াবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সাবেক পুলিশের ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আত্মসমর্পণ করেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
ইন্টারপোলে নোটিশ জারি হওয়া ৬ জন
দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ কাজী মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হয়েছিল ইন্টারপোল থেকে। কিন্তু তারেক ও কায়কোবাদের রিভিউ আবেদনের পর সে নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
তারেক রহমানের অবস্থান যুক্তরাজ্যে, এটা অজানা নয়। বাকিরা কে, কোথায় আছে তা নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছে ইন্টারপোলের বাংলাদেশ ডেস্ক ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।
তারা বলছে, কায়কোবাদ যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রেড নোটিশ থাকা মাওলানা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন মিয়া পাকিস্তানে, চৌধুরী আব্দুল হারিছ (হারিছ চৌধুরী) ভারত বা মালয়েশিয়াতে, রাতুল আহমেদ বাবু ইতালি বা দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং মোহাম্মদ হানিফ থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায়। তবে নিশ্চিত তথ্য নেই।
এদের মধ্যে তাজউদ্দিন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। তার আরও দুই ভাই শামছুল আলম টাঙ্গাইল বিএনপির নেতা আর সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক।
রাতুল আহমেদ মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পিন্টু-তাজুলেরই আরেক ভাই।
হারিছ চৌধুরী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন।
এই ছয়জনের মধ্যে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কায়কোবাদ ও রাতুল বাবুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি দুজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এসেছে।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়েছিলেন মো. ইকবাল। ফাইল ছবি
বাকি ৯ জন
পলাতক বাকি ৯ আসামি হলেন: লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আহমেদ, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সদস্য মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাই।
এদের মধ্যে দুই ভাই মুত্তাকিন ও মুরছালিন জঙ্গি হামলার অভিযোগে ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। একই সাজা হয়েছে মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাইয়ের।
এ টি এম আমিন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিলেন। তিনি ওই সরকারের মেয়াদ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান বলে তথ্য আছে। এরপর তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি। তার কারাদণ্ড হয়েছে দুই বছরের।
সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দারকে নানা সময় কানাডায় দেখা গেছে। তবে এই মামলায় সাজা হওয়ার পর তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য আসেনি। তারও দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
বাকি ছয়জনের অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি মহিউল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ২১ আগস্ট মামলার সকল পলাতক আসামিকে দেশে ফিরিয়ে বিচার কার্যকরের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তদন্তকারী সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে।'
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে পরে মারা যান আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান। ছবি: সংগৃহীত
গ্রেনেড হামলা, মামলা ও বিচার
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা।
তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতা-কর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন।
তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। তখন জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলার ছক করা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে এসেছিল হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ৩০ জন আসামিকে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২। তবে তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত বিচার চলে ৪৯ জনের।
দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলার রায় দেয়া হয়। এতে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড হয়।
এই ৪৯ আসামির মধ্যে আটজন রাজনৈতিক নেতা, পাঁচজন সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য এবং আটজন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা। বাকি ৩১ জন হরকাতুল জিহাদের জঙ্গি।