বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পিবিআই কর্মকর্তার ঘুষ নেয়ার প্রমাণ ফোনালাপে

  •    
  • ২০ আগস্ট, ২০২১ ১৭:০১

নেত্রকোণায় একটি হত্যা মামলার বাদী ও ভাঙচুর মামলার আসামিদের কাছ থেকে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘুষদাতা সেই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ফোন করে টাকা চাওয়ার ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে।

নেত্রকোণায় একটি হত্যা মামলার বাদীপক্ষের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের মামলা করার পর তার প্রমাণ না পেয়ে দুই দফা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

প্রথমে থানার পুলিশ এবং পরে তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছেন, হত্যা মামলার বাদীপক্ষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়।

প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা মিথ্যা অভিযোগ আনায় ভাঙচুরের মামলার বাদীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিলেন। সেই আবেদনে নারাজি দিলে মামলাটি আবার তদন্ত করেন অন্য একজন কর্মকর্তা। আর তিনি হত্যা মামলার বাদীপক্ষের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

ভুক্তভোগীর সঙ্গে পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তার ফোনালাপের একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর নেত্রকোণায় তোলপাড় চলছে। ফোনালাপে শোনা যায়, ঘুষের টাকা ফেরত চাইছেন ভুক্তভোগী। আর পিবিআইয়ের কর্মকর্তা বলছেন, তার কাছে গেলে তিনি টাকা দিয়ে দেবেন।

যাদের মধ্যে লেনদেন

যিনি টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করছেন, তার নাম আবুল হোসাইন। জানিয়েছেন, তার কাছে সব তথ্যপ্রমাণ আছে।

পিবিআইয়ের যে তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে, তিনি হলেন নেত্রকোণা পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর ধনরাজ দাস। তিনি অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, ধনরাজ যে টাকা নিয়েছেন, সেটা তিনি জানেন। আর টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে আলোচনার বিষয়টিও তার জানা।

আবুল হোসাইনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার সেকান্দরনগর গ্রামে। তিনি নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার ডাউকি গ্রামের সাবিজ মিয়ার মেয়ের জামাতা।

শ্যালক জুয়েল মিয়া হত্যার পর আসামিদের বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাটের অভিযোগে কেন্দুয়া থানায় ওই মামলাটির ছয়জন আসামির মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান আসামি।

ফাঁস হওয়া কথোপকথনের কল রেকর্ডের এক প্রান্তে ইন্সপেক্টর ধনরাজ ও অপর প্রান্তে আবুল হোসাইনের কথা বলতে শোনা গেছে। কল রেকর্ডটিতে এই কথাবার্তা বলার কথা ইন্সপেক্টর ধনরাজ ও আবুল হোসাইন দুজনই নিশ্চিত করেছেন।

ধনরাজের দাবি, আসামিদের চাওয়ামতো বিচারিক আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন না দেয়ায় মামলার প্রধান আসামি আবুল হোসাইন তাকে ফাঁসাতে এই কল রেকর্ড যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছেন।

আবুল হোসাইন বলেছেন, মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখানোর কারণেই বাধ্য হয়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তিন ধাপে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধনরাজকে ঘুষ হিসেবে দিয়েছেন। এখন এই টাকা তিনি ফেরত চান।

ফাঁস হওয়া ফোনালাপে কী কথা

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কল রেকর্ডে ভুক্তভোগীকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার অফিসে গিয়া আমি টাকা দিয়া আসছি, আপনি এখন আমার বাড়িতে আইসা টাকাটা দিয়া যান। আমি অভিযোগ উঠাইয়া নিয়া আইয়াম।‘

জবাবে পিবিআইয়ের কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি আসেন। দিয়ে থাকলে নিয়ে যান।’

তখন ভুক্তভোগী বলছেন, ‘নিয়ে থাকলে মানে আপনি কি কিছু নিছেন না?’

ইন্সপেক্টর বলেন, ‘নিমুনা কেরে। আপনি তো মোবাইলে...‘

এভাবেই ৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডে উঠে আসে ঘুষের টাকার লেনদেনের বিষয়টি।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

২০১৮ সালের ১৯ জুলাই রাত থেকে ২০ জুলাই সকালের মধ্যে কোনো একসময়ে খুন হন কেন্দুয়ার ডাউকি গ্রামের সাবিজ মিয়ার ছেলে জুয়েল মিয়া।

সকালে গ্রামের মসজিদের সামনে থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর ওই দিন কেন্দুয়া থানায় নিহতের বাবা সাবিজ মিয়া অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন।

পরে এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। আর নানা হাত ঘুরে তদন্তের ভার আসে ইন্সপেক্টর আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে। তিনি গত ৪ ডিসেম্বর সাতজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

১০ ডিসেম্বর আসামি জিয়াউল ও পলাশের বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা হয়, এমন অভিযোগে তার ভাই জুলহাস মামলা করেন। এই মামলাটি হয় গত ২০ জানুয়ারি।

৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকার মালামাল লুট ও ভাঙচুরের এই মামলায় খুন হওয়া জুয়েলের মা ললিতা আক্তার, ভগ্নিপতি আবুল হোসাইনসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়।

এই মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা কেন্দুয়া থানার এসআই নোমান সাদেকীন গত ২ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালতে ‘ঘটনা মিথ্যা’ উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।

‘মিথ্যা মামলা’ করার জন্য বাদী জুলহাস মিয়ার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারা প্রয়োগের প্রস্তাবও দেন তদন্ত কর্মকর্তা নোমান সাদেকীন।

ধনরাজ যেভাবে মামলায় সম্পৃক্ত

নোমান সাদেকীনের দেয়া প্রতিবেদন বাদী প্রত্যাখ্যান করে পুনঃতদন্তের আবেদন করায় আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়।

এই পর্যায়ে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান ইন্সপেক্টর ধনরাজ দাস। তদন্ত শেষে গত ১৩ এপ্রিল তিনি বিচারিক আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।

তিনি এবার মিথ্যা মামলা করায় শাস্তির সুপারিশ না এনে উল্লেখ করেন, রাতের আঁধারে মালামাল লুট হওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি।

ইন্সপেক্টর ধনরাজ কী বলছেন?

নিউজবাংলাকে পিবিআইয়ের কর্মকর্তা বলেন, ‘আবুল হোসাইন নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছিলেন মামলার বাদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার অভিযোগ করতে। কিন্তু ঘটনার সত্যতা থাকায় তার আবদার রাখার সুযোগ ছিল না। এ কারণেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ তুলছেন। তার শাশুড়িকে দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দিচ্ছেন।’

১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার কথা তিনি অস্বীকার করার পর কল রেকর্ডের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে ধনরাজ বলেন, ‘প্রায় দুই মাস আগে আবুল হোসাইনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি কথা বলার সময় বারবার টাকা ফেরত চাচ্ছিলেন। বাজেভাবে কথা বলছিলেন। আমার বিকাশ নম্বরে এক হাজার টাকা পাঠানোর কথা আবুল হোসাইন আমাকে বলেছেন। আমি বলেছি প্রমাণ দিয়ে টাকা নিয়ে যেতে।’

আবুল হোসাইন কী বলছেন

পিবিআইয়ের কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ আনা আবুল হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলায় আমাদের দায় দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দেয়ার ভয়ভীতি দেখান ধনরাজ। এমনকি একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে তার অফিসে আটকে রাখেন টাকার জন্য।

‘পরে টাকা দেয়ার অঙ্গীকার করে সেদিন তার অফিস থেকে ছাড়া পাই। বাধ্য হয়ে প্রথম দফায় তাকে হাতে হাতে নগদ ১ লাখ টাকা, পরে ১৯ হাজার টাকা দিই। বাকি ১ হাজার টাকার জন্য বারবার তাগাদা করছিলেন ধনরাজ। শেষে ১ হাজার টাকা বিকাশে দিই। এখন আমি এই টাকা ফেরত চাই।’

টাকা দেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে ফোনে বলা কথাবার্তার রেকর্ড আছে বলেও জানান আবুল।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বললেন, ঘটনা সত্য

ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডের কথাবার্তায় উঠে আসে কেন্দুয়া উপজেলার সান্ধিকোনা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবুল হাসেমের নামও।

তিনি বলেন, ‘টাকা তো নিছেন ধনরাজ দাস। ১ লাখ ২০ হাজার টাকাই নিছেন। এটা সত্য। আমি জানি। ধনরাজ দাস আমাকে ফোন করেছিলেন। ফোনে তিনি বলেছেন, আবুল হোসাইন যেন সমস্যার সৃষ্টি না করেন। টাকাটা দিয়ে দেবেন। আর যাতে কেউ না শোনে। কিন্তু ধনরাজ দাস পরে আর টাকাটা ফেরত দেননি।’

পিবিআই কী বলছে

ধনরাজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোণা পিবিআইয়ের কার্যালয়ের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শংকর কুমার দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধান তদন্ত করে সত্যতা পেলে নিশ্চয়ই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এখানে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নাই।’

এ বিভাগের আরো খবর