বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাবুনগরীর মৃত্যুতে নতুন সংকটে হেফাজত

  •    
  • ২০ আগস্ট, ২০২১ ১৩:৫০

হেফাজতকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো একক নাম নেই। আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালকের পদই কাউকে দেয়া যায়নি প্রায় এক বছরেও। আবার গত কয়েক মাসে বাবুনগরী হেফাজতের ভেতর দুই পক্ষের কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। উল্টো সবার বিরাগভাজন হয়েছেন। নানা কারণে নতুন নেতৃত্ব বাছাই করা হেফাজতের জন্য সহজ হবে না।

১০ বছরের নেতা শাহ আহমদ শফীর যতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল হেফাজতে ইসলামে, ততটা ছিল না জুনায়েদ বাবুনগরীর।

তার নেতৃত্বে আসা নিয়ে সংগঠনে ভাঙন ধরে কমিটি গঠনের আগেই। আবার কমিটি গঠনের পরেও অন্তত দুইজন নায়েবে আমির বাবুনগরীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা দেখিয়ে সংগঠন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ঢাকার একজন নেতা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

তারপরেও হেফাজতে বাবুনগরীর দৃশ্যত কোনো বিকল্প ছিল না। যে কারণে সংগঠন কমিটি ভেঙে দেয়ার পরেও তিনিই ছিলেন নেতৃত্বে। আর গত এপ্রিলে ধরপাকড়ের পর থেকে তিনিই সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে গেছেন।

তার মৃ্ত্যু হয়েছে অকস্মাৎ। এটি সমর্থকদের জন্যও একটি আঘাত, সংগঠনের জন্যও তৈরি করেছে সমস্যা।

এর কারণ, নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তার সুযোগ আছে কি না, তা নিয়ে আছে প্রশ্ন। আবার নেতৃত্বে আসার মতো একক কোনো নামও নেই সংগঠনে।

২০১০ সালে হেফাজত গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত নেতৃত্ব ধরে রেখেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা। হেফাজতের নেতৃত্ব তাদের মধ্যেই রাখতে আগ্রহী। কিন্তু দ্বন্দ্ব-বিরোধের আশঙ্কায় আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর মাদ্রাসার মুহতামিমই নির্বাচিত করা যায়নি কাউকে। এই অবস্থায় হেফাজতের নেতৃত্বে একজনকে আনাটা কঠিন হবে তাদের জন্য।

সংগঠনের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুহিব্বুলাহ বাবুনগরীর একটি অবস্থান আছে হেফাজতে। কিন্তু তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক নন। পাশাপাশি তার বয়স ৯০ বছরের বেশি। তাকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হলেও এই দুটি কারণে তিনি পূর্ণাঙ্গ আমিরের পদ পাবেন কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।

হেফাজতের ভারপ্রাপ্ত আমির আল্লামা মুফতি মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। ছবি: নিউজবাংলা

হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী এখন দৃশ্যত প্রধান নেতা। কিন্তু তার প্রভাব সংগঠনে কম। আর তিনি ঢাকার নেতা হিসেবে আমির হওয়ার তালিকায় তার নাম না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

গত মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় শক্তি দেখাতে গিয়ে সংগঠনের অবস্থা এখন নিভু নিভু।

শতাধিক নাশকতার মামলা, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার, আত্মগোপন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের পদত্যাগ এবং হেফাজতে ইসলামের অপর একটি অংশের প্রকাশ্যে বর্তমান কমিটির বিরোধিতার কারণে ২০১৩ সালে ভীষণ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা সংগঠনটি এখন আলোচনাতে নেই বললেই চলে। নানা হুমকিধমকি দিয়ে আসা নেতারা পরে সরকারের কাছে অনুনয় বিনয় করে আসছেন।

সব মিলিয়ে যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্যেই মৃত্যু হলো বাবুনগরীর।

২০২০ সালে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলোচিত এ ধর্মীয় সংগঠনটি গত নভেম্বরে যে জাতীয় সম্মেলন করে তাতে প্রয়াত আমির আল্লামা শফীর অনুসারীরা পদ-পদবি পাননি। তারপর থেকে ওই অংশ বর্তমান কমিটির বিরোধিতা করে আসছে।

ফলে এক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে সংগঠনটি। বাবুনগরীর মৃত্যুর পর সংগঠনটি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়বে কি না সেটি এখন দেখার বিষয়।

বাবুনগরীর অনুসারী হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস বৃহস্পতিবার বিকেলে হাটহাজারী মাদ্রাসায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাবুনগরীর মৃত্যুর কারণে সংকট তৈরি হবে। তবে আশা করি সেটি বেশি দিন স্থায়ী হবে না। সংকট দ্রুত কেটে যাবে। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।’

সংগঠনের পরবর্তী নেতৃত্বে কে আসবেন- এমন প্রশ্নে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল আওয়াল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনও এ বিষয়ে কোনো সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে আমি এখন কিছুই বলতে পারব না। তবে দ্রুতই এ বিষয়ে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব।’

হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালকই নির্বাচন করা যায়নি

হেফাজতের নতুন নেতা বেছে নেয়া যে সহজ হবে না, তা হাটহাজারী মাদ্রাসার নেতৃত্বশূন্যতাই বলে দেয়।

কওমি অঙ্গনের শীর্ষ মুরব্বি হিসেবে এই মাদ্রাসা ও হেফাজতে আল্লামা শফীর একক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও তার মৃত্যুর পর চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। গত এক বছরে মাদ্রাসার নতুন মহাপরিচালক নির্বাচন সম্ভব হয়নি।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা শফীর মৃত্যু হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর দাফন শেষে মাদ্রাসার মজলিসে সুরার বৈঠকে মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য তিন শিক্ষক মুফতি আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ আহমদ সাহেব ও মাওলানা ইয়াহইয়াকে নিয়ে আমেলা (পরিচালনা কমিটি) গঠন করা হয়। কিন্তু এই কমিটি এখনও একজনকে মাদ্রাসার পরিচালক বা মুহতামিম ঘোষণা করতে পারেনি।

হাটহাজারী মাদ্রাসার তাফসির বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি নামে আছে। সবকিছু জুনায়েদ বাবুনগরী নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার কথায় মাদ্রাসার চলত। তিনি মারা যাওয়াতে মাদ্রাসায় নতুন মহাপরিচালক নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরি হবে।’

সংগঠনে ঐক্য নেই

গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার কদিনের মধ্যেই আল্লামা শফীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফাটল ধরে সংগঠনে। মাদ্রাসায় হাঙ্গামার সময় তাকে চিকিৎসা দিতে বাধা, এমনকি অক্সিজেনের নল খুলে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছে প্রয়াত আমিরের পরিবার।

আর শফীর শ্যালক এই ঘটনায় হত্যা মামলা করেন বাবুনগরীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। এতে অবহেলাজনিত নরহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে এখনও বিচার শুরু হয়নি।

গত নভেম্বরে জাতীয় সম্মেলন করে বাবুনগরীকে আমির করে যে কমিটি ঘোষণা করা হয়, তাতে শফী অনুসারী কাউকে রাখা হয়নি। এই কমিটিতে স্থান দেয়া হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক শতাধিক নেতাকে।

আর নতুন কমিটি গঠন করার পর হঠাৎ করেই তারা সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নামার হুমকি দিতে থাকে।

নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা করে। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাণ্ডব ছিল নজিরবিহীন। হেফাজত নেতারা এ সময় বলতে থাকেন, দেশ চালাতে হলে সরকারকে তাদের কথা শুনেই চালাতে হবে।

কিন্তু এপ্রিলের শুরুতে হেফাজত নেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারী সঙ্গীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হেফাজত নেতারা তাৎক্ষণিক সহিংসতা চালিয়ে ত্রাস তৈরি করলেও কয়েক দিন পরেই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। সরকার যখন অভিযান শুরু করে, তখন হেফাজত চুপসে যায়।

গত ২৬ এপ্রিল নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ার পর হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।

নানা নাটকীয়তার পর গত ৭ জুন ৩৩ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। আগের কমিটির মধ্যে যারা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক ছিলেন, তাদের সবাইকেই বাদ দেয়া হয়।

এই সিদ্ধান্ত আবার সংগঠনের বাদ পড়া নেতারা মেনে নিতে পারেননি। আগের কমিটির নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী ফেসবুক স্ট্যাটাসেই বাবুনগরীর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন।

এভাবে বাবুনগরী সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে গিয়ে কার্যত একূল-ওকূল সবই হারান।

আল্লাম শফীর অনুসারীদের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে প্রয়াত আমিরের বড় ছেলে ইউসুফ মাদানীকে সহকারী মহাসচিব করা হয়। তবে ওই দিনই ইউসুফ মাদানী তা প্রত্যাখ্যান করেন।

হেফাজত যেভাবে আলোচনায়

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রস্তাবিত নারী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে কওমি ঘরানায় গড়ে তোলা হয় হেফাজতে ইসলাম। নেতৃত্বে আল্লামা শফী। অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও এতে কওমি ঘরানার সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল।

তবে সংগঠনটি ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে। সে সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সারা দেশে গণজাগরণ নামে আন্দোলন চলছিল।

এই আন্দোলনকারীদের নাস্তিক দাবি করে মাঠে নামে হেফাজত। একপর্যায়ে ৫ মে ঢাকা অবরোধ ডাকে।

সেদিন বিকেলে রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে তারা। সমাবেশ শেষে সেখান থেকে সরে যেতে অস্বীকার জানায়। একপর্যায়ে ডাক দেয় সরকার পতনের। তবে রাতে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশের যৌথ অভিযানে শাপলা চত্বর ছাড়ে তারা।

২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ। ছবি: সংগৃহীত

অভিযানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর গুজব ছড়ালেও পরে এর কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে এই বিষয়টিই সংগঠনটিকে দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত করে তোলে। এই ঘটনার পর পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর হেফাজতের রাজনৈতিক গুরুত্বও তৈরি হয়।

আর একপর্যায়ে আল্লামা শফী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাদ্রাসার সমমানের দাবি আদায় করেন।

এ বিভাগের আরো খবর