জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির ময়দান পর্যন্ত ছিল অনন্য বিচরণ। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ভাবনা জুড়ে ছিল দেশের যুবসমাজ। সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন শেখ কামাল।
শেখ কামালের ৭২তম জন্মবার্ষিকীতে বৃহস্পতিবার নিউজবাংলার বিশেষ আয়োজন ‘চিরঞ্জীব চিরভাস্বর শেখ কামাল’ অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন বক্তারা।
ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্যে শেখ কামালের বন্ধু সালমান এফ রহমান বলেন, ‘সব সময় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই ব্যস্ত থাকত শেখ কামাল। যখন আবাহনী ক্রীড়া চক্র যাত্রা শুরু করেছিল, তখন কিন্তু মোহামেডান ছাড়া মানসম্মত কোনো ক্লাব ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে মোহামেডানের মানের মতো আরেকটি ক্লাব গঠন করাই ছিল আবাহনী ক্রীড়া চক্র গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য।’
শেখ কামালের বহুমুখী প্রতিভার কথা তুলে ধরে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘সে নিজেও ভালো খোলোয়াড় ছিল। ভালো খেলত ক্রিকেট, ফুটবল ও বাস্কেটবল। ভালো গানও করতে পারত, গিটার বাজাতে পারত।’
নিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা তুলে ধরে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘শেখ কামাল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। নটরডেম কলেজ থেকে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক, যা আরও গাঢ় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়। আমরা এক সঙ্গে ৬৯-এর আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল সিদ্ধান্ত নিলো আবাহনী ক্রীড়া চক্র গঠনের। সেখানেও আমি তার সঙ্গী ছিলাম।
‘সব থেকে আমার কাছে যেটা অবাক লাগে সেটা হলো, শেখ কামাল হলো বঙ্গবন্ধুর ছেলে। আপনারা নিজেরাই কল্পনা করতে পারেন, তার কাছে কী ধরনের ইনফ্লুয়েন্স ছিল। অনেকে আসত। বলত, এ ব্যবসাটা করে দাও, ওটা করে দাও। অনেকে অনেক প্রভাবিত করার চেষ্টা করত, কিন্তু কেউ কোনো সময় বলতে পারে নাই, শেখ কামাল কোনো ব্যবসা করেছে। কারও ব্যবসা নিয়েছে বা ব্যবসা নেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।’
আবাহনী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্পন্দনের প্রতি শেখ কামালের ভালোবাসার কথা জানিয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘আমার মনে আছে, আমি একবার লন্ডন যাচ্ছিলাম। তাকে বললাম, তোমার জন্য কী আনব। বন্ধু হিসেবে সে তো বলতে পারত, একটা ঘড়ি এনে দাও বা একটা টাই এনে দাও। অথচ সে বলল, আবাহনীর জন্য কেইডস নিয়ে এসো।
‘একবার জাপান যাচ্ছিলাম। আবার তাকে বললাম তোমার জন্য কী আনবো? একই কথা। নিজের জন্য কিছুই না। বললো ঠিক আছে, তুমি সেখানে যাচ্ছো, ওখানে ইয়ামাহার ইলেকট্রিক অর্গানটা নিয়ে এসো স্পন্দনের জন্য।’
এক প্রশ্নের জবাবে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘শেখ কামাল বেঁচে থাকলে আমি বিশ্বাস করি, তিনি আজ প্রধানমন্ত্রী হতেন। রাজনীতিবিদ হতেন। উনি বেঁচে থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এত কষ্ট করতে হতো না। তিনিই দেশের দায়িত্ব নিতেন।’
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘শেখ কামাল শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। কারণ, তাকে আমরা দেখি সব জায়গায়। তাকে দেখি খেলার মাঠে। তাকে দেখি নাটকের মঞ্চে, তাকে দেখি রাজনীতির মঞ্চে। তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকও ছিলেন। তার পদচারণা ছিল না, এমন কোনো এলাকা আমরা দেখিনি।’
যুব সমাজের প্রতি শেখ কামালের ভালোবাসার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই যুগে যখন আমরা অর্থনীতির কোনো পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই, কোনো বিষয় গভীরভাবে বিবেচনায় আনি, তখন প্রথমেই আমরা মাথায় নেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। দেশে যুব সমাজ কতটা রয়েছে। কতটা মানুষ কর্মক্ষম তা চিন্তা করি। শেখ কামাল যে পরিবারে জন্ম, শেখ কামালের তখনকার যে অবস্থান, সেই অবস্থানে থেকে যে কোনো দিকে যেতে পারতেন। যা খুশি হতে পারতেন, কিন্তু সব কিছু ছেড়ে শেখ কামাল বেছে নিয়েছেন যুব সমাজকে।
‘তিনি সুস্পষ্টভাবে বিশ্বাস করতেন, আমাদের আগামী প্রজন্মই একদিন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যুব সমাজের ওপর তিনি অত্যন্ত বিশ্বাসী ও আশাবাদী ছিলেন। সেজন্য তার প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডই নিবেদিত ছিল যুব সমাজকে ঘিরে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আবাহনীর শুরুর দিকে আমি জড়িত ছিলাম এবং শেখ কামালের রেখে যাওয়া আবাহনী ক্লাবের মাঠ দিয়েই আজকে আমার পরিচয়। প্রায় ২০ বছর আবাহনী ক্রিকেটের সভাপতি ছিলাম। এখনও আবাহনীর আমি একজন পরিচালক। আবাহনীর পরিচালক হওয়ার কারণেই আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হলাম। এর ওপর দাঁড়িয়েই আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে আইসিসির সভাপতি হয়েছি। আমি যা করেছি, আমার যা অর্জন, তার সবগুলোর পেছনে আছেন শেখ কামাল।’
অনুষ্ঠানে শেখ কামালের শেখ কামালের বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
তিনি বলেন, ‘বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় ঘটা একজন ব্যক্তিত্ব বলতে যা বুঝানো হয়, শেখ কামাল ছিলেন সে ধরনের একজন মানুষ। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ও প্রদীপ্ত মেধার আলোয় উদ্ভাসিত। সব কিছু ছাড়িয়ে তিনি সর্বোচ্চ মনোযোগী ছিলেন খেলাধুলায়। তার সমসাময়িককালে এতো বড় ও উচ্চতার ক্রীড়া সংগঠক বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে দ্বিতীয় জন জন্ম নেয়নি।’
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘সাংস্কৃতিক অঙ্গনেরও পুরোধা ছিলেন শেখ কামাল। নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন স্পন্দন শিল্প গোষ্ঠী ছিল তখনকার বাঙালি সমাজের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার সূতিকাগার। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যে স্পন্দন তিনি রেখে গেছেন তা আধুনিক তরুণ সমাজের প্রেরণার উৎস। মঞ্চ নাটকেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। নাট্যচক্র নামে নাট্যগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ছিলেন তিনি।
‘সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। একজন তুখোড় ছাত্রনেতা, ক্ষমতাসীন রাজনীতির খুব কাছের মানুষ হয়েও তিনি কোনোদিন প্রধানমন্ত্রী বাবার প্রভাব খাটাননি। রাজনৈতিক শিষ্টাচার চর্চায় তিনি থেকেছেন আর দশটা সাধারণ কর্মীর মতোই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে চিরতরে নিভিয়ে দেয়া হয় এই ক্ষণজন্মা প্রতিভার আলোকবর্তিকাকে।’
এক প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘২৩-২৪ বছর বয়সে আমরা কেউ শিক্ষায় থাকি। কেউ চাকরি খুঁজি কিংবা করি। শুধু নিজের উন্নতির চেষ্টাই করে থাকি, কিন্তু শেখ কামাল ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ। তার মতো মানুষকে যদি আমরা অনুসরণ করতে পারতাম তাহলে সমাজ হতো গতিশীল, জীবন হতো শৈল্পিক আর বাংলাদেশ হতো সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বের উন্নত, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র।’