বস্তিতে মাসে ভাড়া গুণতে হয় প্রায় ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকার কাছাকাছি। সেখানে সুবিধা সীমিত। ঝড় বৃষ্টিতে কষ্টের সীমা থাকে না। সেই দিন এখন শেষ হতে চলছে রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাউনিয়াবাদ, কলাবাগান এলাকার ৩০০ বস্তিবাসীর। তারা এখন কম টাকায় উন্নত সুবিধাসম্পন্ন বহুতল ফ্ল্যাটে থাকবেন।
মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সব বস্তিবাসীর জন্য রাজধানীর মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশন ১৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ফ্ল্যাট হস্তান্তর করবেন।
১৪ তলার পাঁচটি ভবনে ৫৩৩টি আধুনিক ফ্ল্যাট রয়েছে। লিফট, জেনারেটর, সৌরবিদ্যুৎ, প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, বিদ্যুতের সাবস্টেশন ও সৌন্দর্যবর্ধনের লাইটিংসহ আধুনিকতায় সমৃদ্ধ করা হচ্ছে এই জায়গা।
এই প্রথম বস্তিবাসীদের নিয়ে এমন উন্নত বাসস্থানের চিন্তা করা হয়েছে।
রোববার দুপুরে স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস আলী মোল্লা ও প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লটারির মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট নির্ধারণ করে দেন।
মঙ্গলবার সকালে দশটি বাসে করে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে তাদের হাতে তুলে দেবেন স্বপ্নের দলিল।
প্রকল্প পরিচালক ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মোস্তফা কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মাঝে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করবেন। প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়া সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এছাড়া সাথে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। সেটি এখনও নির্ধারণ হয়নি।
মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এখানে যে তিনটি ভবনে তারা উঠবেন, সেগুলোর প্রায় ৯০ ভাগ কাজ শেষের পথে। আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করা হবে।’
রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১৪ তলা পাঁচটি ভবনের মধ্যে তিনটির কাজ প্রায় শেষের পথে। এই তিনটির তিনশটি ফ্ল্যাটে উঠবেন বস্তিতে থাকা ছিন্নমূল মানুষেরা। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ৬৭৩ বর্গফুট। এক একটি ফ্ল্যাটে রয়েছে দুটি করে বেডরুম, একটি বারান্দা, একটি ড্রয়িং রুম, বেসিন, রান্নাঘর ও দুটি বাথরুম। দুপাশে ফাঁকা জায়গা। পেছনের দিকে বেড়িবাঁধ অংশের খাল। সামনে প্রশস্ত সড়ক।
ভবনে কাজ করছেন এমন নির্মাণ শ্রমিকেরা নিউজবাংলাকে জানান, মোটামুটি সব কাজ শেষের দিকে। এখন শুধু জানালার গ্লাস, কিছু কিছু অংশে টাইলস, লিফট, ফ্ল্যাটের দরজা লাগানো বাকি আছে। এগুলো বাদে প্রায় ৮৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ভাড়া সাড়ে ৭ হাজার টাকা হলে প্রতি বর্গফুটে ভাড়া আসে সাড়ে ১১ টাকার কাছাকাছি আর পুরো ফ্ল্যাটের দৈনিক ভাড়া আড়াইশ টাকা। পাশেই যারা এখন বস্তিতে আছেন, ১০০ বর্গফুট ঘরের জন্য ভাড়া গুণতে হয় প্রায় ২ হাজার টাকার কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া দাঁড়ায় ২০ টাকা। তবে সেখানে বাড়তি কোনো সুবিধা নেই। বরং যে কোনো সময় উচ্ছেদ আর আগুন আতংকে দিন পার করতে হয়।
ফ্ল্যাট পেয়েছেন এমন কয়েকজন যদিও ভাড়া নিয়ে একটু আপত্তি করেছেন, তবে তারা খুশি এমন আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ঘর পেয়ে।
যে জমিতে ভবন তোলা হয়েছে, সেখানে একসময় বস্তিতে থাকতেন শাহানা বেগম। এখন তিনি পাশের কলাবাগান বস্তিতে থাকেন। তাকে ফোন দেয়া হয়েছে লটারিতে উপস্থিত থাকার জন্য।
কীভাবে ফ্ল্যাট পেয়েছেন জানতে চাইলে শাহানা বলেন, ‘আমি এইখানেই থাকতাম আগে। বর্তমানে পাশের কলাবাগান বস্তিতে থাকি। আমার নাম আছে। কাইল (গতকাল) ফোন দিছিল আসার জন্য। আতি আইছি। আজ ফ্ল্যাট দিব।’
রীনা বেগম পাশের কলাবাগান বস্তিতেই থাকেন। তবে এই জায়গা উচ্ছেদ করার পর ফ্ল্যাটের জন্য তিনিও আবেদন করার সুযোগ পান। রীনা বেগমের স্বামী নেই। বাচ্চাদের নিয়ে গৃহকর্মীর কাজ করেন। ভাড়া দিতে হবে জেনে একটু কষ্ট পেয়েছেন। তবে ফ্ল্যাটে সব সুবিধা আছে জেনে খুশি তিনি।
রীনা বলেন, ‘আমাগো প্রধানমন্ত্রী যদি একটু ভাড়াডা কমাইতো, তাইলে আরও ভালা হইত।’
শুক্কুর শেখ ভাড়া কত তা এখনও জানেন না। তবে ফ্ল্যাট পেয়েছেন এতেই খুশি তিনি।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, পুরো প্রকল্পে জমির পরিমাণ ছয় বিঘা। এই জমিতে আগে বস্তি ছিল। ২০১৭ সালে তা ভেঙে ফেলা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়।
কীভাবে বস্তির মানুষ নির্ণয় করা হয়েছে
যেখানে বস্তি ভেঙে ভবন তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে আগে যারা ছিলেন, তারা অনেকেই অভিযোগ করছেন, তারা ভবনে থাকার জন্য অনুমতি পাননি। তবে নিউজবাংলা অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে, শুধু যাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে বস্তি হিসেবে ঠিকানা দেয়া আছে, শুধু তাদেরকেই যাচাই-বাছাই করে যোগ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এমন তিনশ জনকে প্রাথমিক ধাপে ফ্ল্যাট দেয়া হবে। যারা পান নি, তাদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে বাকি ২৩৩টি ফ্ল্যাট দেয়া হবে।
এই ভবনের আশেপাশে আরও কয়েকটি বস্তি রয়েছে। সেখানে ভাড়া থাকছেন অনেকে, যারা আগে এই প্রকল্পের আশপাশেই থাকতেন। তাদের অভিযোগ, তাদের ঘর ভেঙে ফেলা হলেও ফ্ল্যাটের তালিকায় নাম ওঠেনি। বস্তি ভেঙে ফেলার পর সবাইকে ফ্ল্যাটের আবেদন করার কথা বলা হয়। সে সময় সবাই ফ্ল্যাটের আবেদন করেন।
এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী শুধুমাত্র বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট দেয়া হবে। অনেকেই বস্তি এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তবে তারা প্রকৃত বস্তিবাসী নন। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে বস্তির ঠিকানা দেয়া আছে, শুধু তারাই ঘর পাবেন।’
তাবেদুন নবী বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশে নয়, এই উপমহাদেশেই এটা প্রথম। আমাদের কাছ থেকে এই প্রকল্পের যাবতীয় বিষয় ইন্ডিয়ান হাইকমিশন নিয়েছে। তারাও তাদের দেশে উত্তরাখণ্ড ও ঝাড়খণ্ডে এমন আবাসন গড়ে তুলবে।’
তবে তাবেদুন নবী ফ্ল্যাটের ভাড়া সাড়ে ৪ হাজার টাকা উল্লেখ করেন। নিউজবাংলা আরও কয়েকটি সূত্র থেকে ভাড়া সাড়ে ৭ হাজার টাকা বলে নিশ্চিত হয়েছে।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশল ও সমন্বয় উইংয়ের সদস্য কাজী ওয়াসিফ আহমাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যারা এখানে আগে থাকতেন, তাদের জীবন ব্যবস্থা ভালো করার জন্য সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টের মতো সব সুবিধা থাকবে। এখানে প্রতিটি ভবনে লিফট, জেনারেটর, বিদ্যুতের সাব স্টেশনসহ আধুনিক সব সুবিধা পাওয়া যাবে।’
গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মতে, মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী মোট সাতটি প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। এর মধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ছয়টি প্রকল্প রয়েছে। বস্তিবাসী ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্মিত পাঁচটি আবাসন প্রকল্পের ২ হাজার ৪১৬টি ফ্ল্যাট প্রকল্প উদ্বোধন করবেন শেখ হাসিনা। এগুলো আজিমপুর, মিরপুর, মতিঝিল ও মালিবাগ এলাকায় অবস্থিত।