গত এক বছরে ২১ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) প্রকল্পে। করোনা মহামারির কারণে কাজের গতি কিছুটা কমলেও এরই মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ঠিক যতটা এগোনোর কথা ছিল, তা না হওয়ায় ঢাকার উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে চার সেট ট্রেন দেশে এসেছে। এ অবস্থায় আগামী মাসে ভায়াডাক্টের (ট্র্যাক) ওপর টেস্টরান (পরীক্ষামূলক) করতে চায় সরকার।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মেট্রোরেলের একটা অংশ চালু হওয়ার কথা ছিল। সেটি হচ্ছে না। কারণ কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষবিহীন প্রায় বছর খানেক ট্রায়াল রানের পর শুরু হবে যাত্রী চলাচল। সে হিসেবে আগামী বছরের আগস্টের আগে এ পথে মেট্রোরেল চলাচলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, যদিও কর্মকর্তারা মেট্রোরেল কবে নাগাদ চালু হতে পারে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলছেন না।
মেট্রোরেল প্রকল্প-৬-এর বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এরআরটি-৬-এ ইতোমধ্যে ১৬ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট বসানো হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নির্মাণকাজ চলছে।
ঢাকার যানজট নিরসন এবং দ্রুত ও আরামদায়ক যাতায়াত নিশ্চিত করতে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সব মিলিয়ে ১২৮ কিলোমিটারের নেটওয়ার্ক হবে মেট্রোরেলের।
প্রথম শুরু হয় এমআরটি-৬-এর কাজ। ২০১২ সালে নেয়া মেট্রোরেলের এ প্রকল্পে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।
ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাকডাউনে কাজের কিছু সমস্যা হবেই। এখানে হাজার হাজার লোক কাজ করেন। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এসব আমরা মেনে চলছি। তাই তার একটা ইমপ্যাক্ট তো অবশ্যই পড়বে। তবে কাজ বন্ধ নেই।’
কাজের অগ্রগতি
মূলত তিনটি ভাগে হচ্ছে মেট্রোরেলের কাজ। প্রথম অংশ উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ের সার্বিক অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা কাজের অগ্রগতি ৫৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ ছাড়া মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করার জন্য ডিটেইল ডিজাইন ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান।
আটটি প্যাকেজের আওতায় এমআরটি-৬-এর কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম দুই প্যাকেজে ডিপোর ভূমি উন্নয়নকাজ ও পূর্তকাজ শেষ। গত জুন পর্যন্ত প্যাকেজ-৩ ও ৪-এর আওতায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৯টি স্টেশন নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে, অগ্রগতি ৮২ দশমিক ১৭ শতাংশ। প্যাকেজ-৫-এর আওতায় আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ৩ দশমিক ২০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও তিনটি স্টেশন নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। প্যাকেজ-৬-এ কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও চারটি স্টেশন নির্মাণের অগ্রগতিও ৭০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্যাকেজ-৭-এর আওতায় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেমের অগ্রগতি ৭২ শতাংশ। সব শেষ প্যাকেজ-৮-এ রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহের অগ্রগতি হয়েছে ৫০ শতাংশ।
২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার ভায়াডাক্টের মধ্যে ১৫ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে। উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাবস্টেশনের পূর্তকাজ শেষ করে বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। মতিঝিল রিসিভিং সাবস্টেশনের ভবন নির্মাণকাজ চলছে।
ডিপো এলাকার ওয়ার্কশপ শেডের ভেতরে ১২টি রেললাইনের নির্মাণকাজও শেষ। আগারগাঁও পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক লাইনের মধ্যে সাড়ে ১৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক অ্যালাইনমেন্টের কাজ শেষ হয়েছে। তার মধ্যে ১৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় অর্ধেক স্টেশনের মূল অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ হয়েছিল ৪৬ দশমিক ১৩ শতাংশ, যা চলতি বছরের জুনে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এতে গত এক বছরে এ প্রকল্পে অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত অগ্রগতি ছিল ৪৪ দশমিক ১২ শতাংশ। সে হিসাবে করোনাকালীন মোট অগ্রগতি হয়েছে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।
আগামী মাসেই টেস্ট রান
এমআরটি-৬ রুটে মোট ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। প্রতি সেট ট্রেনে দুটি ইঞ্জিনসহ ছয়টি বগি থাকবে। প্রথম সেট ট্রেন ঢাকায় এসেছে গত ২৩ এপ্রিল। এরপর উত্তরায় ডিপোতে সেটির ১৯ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা রিসিভিং ইন্সপেকশন সম্পন্ন করা হয়। প্রথমবার ১৪ মে ডিপোর ভেতর ট্রায়াল ট্র্যাকে প্রায় ৫০০ মিটার তা চালিয়ে দেখা হয়।
বর্তমানে প্রথম সেট ট্রেনের ডিপোতে ফাংশনাল টেস্ট চলছে। এরপর আগামী মাসে (আগস্টে) ভায়াডাক্টের ওপর পারফরমেন্স টেস্ট বা টেস্ট রান করা হবে।
এর মাধ্যমে উড়ালপথে মূল লাইনের ওপর ট্রেনের প্রথম চলাচল দেখতে পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে ট্রেনের সঙ্গে রেললাইন, বিদ্যুৎ ও সংকেতব্যবস্থা যুক্ত করে দেখা হবে। পারফরমেন্স টেস্টের পর ছয় মাসের ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট করা হবে। এর পরেই হবে ট্রয়াল রান। তবে তাতে এখনও অনেকটাই দেরি হবে। আর মানুষবিহীন প্রায় বছর খানেক ট্রায়াল রানের পরই শুরু হবে যাত্রী চলাচল।
কবে নাগাদ মেট্রোরেল ট্রায়ালে যেতে পারবে, এ বিষয়ে এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘ট্রায়াল অবশ্যই হবে, তবে কবে শুরু হবে, তা অনেক দূরে। আমরা আগস্ট মাসে ভায়াডাক্টের ওপর টেস্ট রান করব। এটাই এখন আমাদের আগামী টার্গেট। আমরা টার্গেট বাই টার্গেট নিই এবং তা অর্জন করে এগিয়ে যাই। এক সঙ্গে তিন বছরের জন্য টার্গেট নিই না।’
মেট্রোর কোচ
স্টেইনলেস স্টিলের কোচগুলোর ভেতরে দুই পাশে লম্বালম্বি বসার আসন রয়েছে। একটি ট্রেনের দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হচ্ছে ট্রেইলার কার যা ট্রেনকে চালিয়ে নিয়ে যাবে। এতেই চালক থাকবেন।
একটি ট্রেনে বসে যেতে পারবেন ৩০৬ যাত্রী। মাঝের চারটি কোচ মোটরকার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) সাড়ে ৯ ফুট চওড়া কোচের মাঝখানে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবেন। এ জন্য হাতল এবং স্থানে স্থানে খুঁটি আছে। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে এবং দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে ২ হাজার ৩০৮ যাত্রী চড়তে পারবেন। সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারবে এ ট্রেন।
একেকটি ট্রেনের সেট জাপান থেকে দেশে আসতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এরই মধ্যে চার সেট ট্রেন দেশে এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে দুই সেট ঢাকায় ডিপোতেও পৌঁছেছে। আর দুটি সেট বন্দর থেকে ঢাকার পথে রয়েছে।
তৃতীয় ও চতুর্থ সেট গত ২২ জুন জাপানের কোবে সমুদ্রবন্দর থেকে জাহাজে করে দেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। গত ২০ জুলাই সেটি দেশের বন্দরে পৌঁছেছে। এগুলো এখন উত্তরায় ডিপোতে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
ট্রেনের নকশা প্রণয়ন ও তৈরিতে কাজ করছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম। প্রতিষ্ঠানটি সব কাজ শেষ করে পরিপূর্ণ ট্রেনের সেট বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। পঞ্চম সেট ট্রেন ১৬ জুলাই জাপান থেকে রওনা হয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দেশে আসার কথা ছিল। তবে তা সম্ভব হয়নি। এটি দেশে আসতে মাস খানেক দেরি হতে পারে। এভাবে একে একে আসবে ২৪ সেট ট্রেন।
সব ট্রেন কবে আসবে জানতে চাইলে এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘কবে দেশে আসবে তার কোনো লক্ষ্য ঠিক হয়নি। তবে ৫ সেট ট্রেন আসার টার্গেট রয়েছে, তা পূরণে কাজ চলছে। এক-দুই মাসের মধ্যেই তা হবে।’
ডিসেম্বরে হচ্ছে না চালু
মোট প্রকল্পের মধ্যে শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে ডিসেম্বরের মধ্যে রেল চালুর পরিকল্পনা ছিল। তবে করোনার কারণে তা আর হচ্ছে না।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, এমআরটি-৬ শেষ করার কথা ছিল ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে। পরে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক মহামারির কারণে এখন সেই সময়সীমায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রথমে যে সময়সীমা নেয়া হয়েছিল, তার আগেই এমআরটি-৬-এর নির্মাণকাজ শেষ হবে। প্রকল্পের অনেক কর্মীও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
তবে টেস্ট রানের পর কয়েকটি ধাপ পার হয়ে মূল চলাচলে প্রায় দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগবে। কারণ নিরাপত্তা নিশ্চিতে কমপক্ষে এক বছর মানুষবিহীন ট্রায়ালে থাকতে হবে ট্রেনকে।
করোনার হানা
কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গাবতলী ও উত্তরায় কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ফিল্ড হাসপাতাল চালুর পাশাপাশি কর্মীদের টিকা দেয়া হচ্ছে।
জনবলের নিরাপদ অবস্থানের জন্য নির্মাণস্থলের কাছেই আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দেশি জনবলের বেশির ভাগকে দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। তবে বিদেশি জনবলকে টিকা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
জুন পর্যন্ত মেট্রোরেলে কাজে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি জনবলের মধ্যে ৭৩৪ জন কর্মী, শ্রমিক ও কর্মকর্তা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। তবে কেউ মারা যাননি। তবে, প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজনের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার বেড়েছে। যা কাজের গতিকে একটু কমিয়ে দিচ্ছে।