বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পেটের দায়ে দিনে ভিক্ষা, রাতে খদ্দেরের অপেক্ষা

  •    
  • ২৮ জুলাই, ২০২১ ২০:৫১

খদ্দের না থাকলে ভিক্ষা ছাড়া আর কী করব- নিউজবাংলার কাছে এ প্রশ্ন রেখে সাজেদা বলেন, ‘খদ্দের পাব না জেনেও আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি। করোনার শুরু থেকেই এ রকম যাচ্ছে দিনকাল। তারপরও আশায় আশায় রাত জেগে অপেক্ষায় থাকি, যদি কেউ আসে।’

‘ভাই, পেটের দায়ে এখন দিনের বেলায় বোরকা পরে ভিক্ষা করি। আর রাতের বেলায় খদ্দেরের আশায় ফুটপাতে বসে থাকি। কিন্তু কোনো খদ্দের পাই না। কীভাবে বেঁচে আছি তা বলে বোঝাতে পারব না।’

নিউজবাংলার কাছে মঙ্গলবার রাতে আক্ষেপ করে এসব কথা বলছিলেন ৩৫ পেরোনো নারী রেশমা (ছদ্মনাম)।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকার ভাসমান এই যৌনকর্মী জানান, শুধু তিনি না, তার মতো শত শত নারী খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। লকডাউন তাদের জীবন তছনছ করে দিচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই।

রেশমা বলেন, ‘এখন তিন বেলা খাবারই তো জুটছে না। এই যে কোরবানির ঈদ চলে গেল, পেয়েছি শুধু কয়েক টুকরা মাংস। ঈদের শখ মেটানো তো অনেক দূরের কথা।’

মঙ্গলবার রাতেই রমনা পার্ক এলাকায় কথা হয় নানা বয়সী কয়েকজন ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে। তাদের একজন ২৫ বছর বয়সী সাজেদা (ছদ্মনাম) নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাই, আমরা দিন এনে দিন খাই। বিপদের জন্য কোনো সঞ্চয় আমরা রাখতে পারি না। পরিবারের সঙ্গে পাঁচ বছর কোনো সম্পর্ক নাই।

‘এখন যে তাদের কাছে যাব, সেই মুখও নাই। তারপরও তো বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু এই লকডাউনে খদ্দের পাব কোথায়, কেউ তো বাসা থেকেই বের হয় না। তা ছাড়া করোনার কারণে কেউ কাছে আসতে চায় না। এমনকি রিকশাচালকরাও আসে না এখন।’

খদ্দের না থাকলে ভিক্ষা ছাড়া আর কী করব- নিউজবাংলার কাছে এ প্রশ্ন রেখে সাজেদা বলেন, ‘খদ্দের পাব না জেনেও আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি। করোনার শুরু থেকেই এ রকম যাচ্ছে দিনকাল। তারপরও আশায় আশায় রাত জেগে অপেক্ষায় থাকি, যদি কেউ আসে।’

রমনা পার্ক এলাকার আরেক ভাসমান যৌনকর্মী ২৫ বছর বয়সী ছন্দা (ছদ্মনাম) জানান, দিনের পর দিন কাজ না পেয়ে বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না। অনেকেই রাস্তার পাশে যাত্রীছাউনি, ফুটওভার ব্রিজ ও স্টেশনে স্টেশনে থাকছেন।

ছন্দা বলেন, ‘এখন রাতে খদ্দের তো পাই-ই না, দিনের বেলায় ভিক্ষা করে যা কামাই তা দিয়ে কোনো রকমে পেট চালাচ্ছি। বাসা ভাড়া পাব কোথায়?’

তিনি বলেন, ‘গত দেড় বছর ধরেই এই অবস্থা আমাদের। এর মাঝে গার্মেন্টসে চাকরির জন্য গেছি। কিন্তু করোনার কারণে নতুন কোনো লোক নিচ্ছে না কোনো কারখানা। তাই বাধ্য হয়ে দিনের বেলায় বোরকা পরে পথে পথে ভিক্ষা করি, যাতে পুরাতন কোনো কাস্টমার চিনতে না পারে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর এসব ভাসমান যৌনকর্মীর মতো দশা দেশের বিভিন্ন শহরের ভাসমান যৌনকর্মীদেরও। বিষয়টি নিয়ে যৌনকর্মীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।

‘মেয়েগুলো তো ঠিকমতো খেতেও পারছে না’

লকডাউনে নারায়ণগঞ্জের যৌনকর্মীরা কী অবস্থায় আছেন, জানতে কথা হয়েছে সেখানকার যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘অক্ষয় নারী সংঘ’-এর সভাপতি কাজল আখতারের সঙ্গে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এ কথা বলতে গেলে মনে কষ্ট লাগে। মেয়েগুলো তো ঠিকমতো খেতেও পারছে না। ঘর ভাড়া দিতে পারছে না। আমাদের নারায়ণগঞ্জে ৩৫০ জন ভাসমান মেয়ে আছে, যারা যৌনকাজ করে জীবন চালায়।

‘এদের মধ্যে বর্তমানে গর্ভবতী দুজন, বাচ্চা আছে প্রায় ৭০ জনের। প্রতিদিনই ওদের কান্নাকাটি দেখতে দেখতে আর ভালো লাগছে না। ঘরে খাবারদাবার নাই। কাজ নাই। পেটের দায়ে রাস্তায় দাঁড়ালে পুলিশে ডিস্টাব করে।’

কাজল বলেন, ‘গত বছর প্রথম লকডাউনের পর যখন সব স্বাভাবিক হলো, তখন মেয়েগুলো কামকাজ করে চলতে পারছিল। যদিও কাজ কম হচ্ছিল, তারপরও দুই-একটা কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারছিল মেয়েগুলো। এরপর একের পর এক লাকডাউনের কারণে মেয়েগুলো রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না।

‘কী যে কষ্ট এদের বলে বোঝাতে পারব না। বাসা ভাড়া দিতে পারে না। এই লকডাউনের মধ্যে ভাড়া দিতে না পেরে অনেকে বাসা ছেড়ে রাস্তাঘাটে-স্টেশনে থাকছে।’

অক্ষয় নারী সংঘের সভাপতি বলেন, ‘এই লকডাউনের সময় অনেকে (কাস্টমাররা) বাসা থেকেই বের হয় না। কোথাও আড্ডা-জটলা হয় না। আবার করোনা হওয়ার ভয়ে ভাসমান পতিতার কাছে অনেকে আসতে চায় না। তাহলে এরা কী করে খাবে বলেন? ক্যামনে চলব এদের?

‘কারণ মেয়েগুলো কাজই করে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, ঘাট, ফুটপাত এসব এলাকায়। এসব জায়গায় তো এখন মানুষজনই চলাচল করে না। তাহলে এদের চলবে কীভাবে?’

‘এবারের লকডাউনে কেউ কিছু দেয়নি’

গত বছর করোনার কারণে প্রথম যে লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তখন সরকারের পক্ষ থেকে ভাসমান যৌনকর্মীদের সাহায্য করা হলেও এবারের লকডাউনে কেউ কিছু দেয়নি বলে অভিযোগ করেন অক্ষয় নারী সংঘের সভাপতি।

তিনি বলেন, ‘এবারের লকডাউনে আমরা কোনো প্রণোদনা পাইনি। কেউ কিছু দেয়নি ভাসমান যৌনকর্মীদের। তবে প্রথমবার যখন লকডাউন দেয়, তখন সরকার থেকে সাহায্য পাইছিল সবাই। কিন্তু এবার খুবই খারাপ অবস্থা সবার। ঈদে কেউ কোনো শখ পূরণ করতে পারেনি। জুটেছিল শুধু সামান্য কয়েক টুকরা মাংস।’

পেট চালাতে বোরকা পরে ভিক্ষাবৃত্তি

ক্ষুধার জালায় নারায়ণগঞ্জের অনেক ভাসমান যৌনকর্মী বোরকা পরে দিনের বেলায় ভিক্ষা করছেন বলে জানান অক্ষয় নারী সংঘের সভাপতি।

তিনি বলেন, ‘ভিক্ষাও যে ভালো হচ্ছে, তাও না। কারণ দোকানপাট খোলা নাই, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। তাই অনেক ভাসমান মেয়ে পথে পথে ভিক্ষা করছে, যা পাচ্ছে তাই দিয়ে কোনো রকম চাল-পানি খেয়ে দিন পার করছে।’

কাজল জানান, কিছু মেয়ে আছে যারা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করলেও সমাজ জানে না। অনেক মেয়ে আছে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।

‘কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তাদের অনেকে বাসা ছেড়ে দিয়ে এদিক-সেদিক দিন কাটাচ্ছে। কারণ বাড়িওয়ালারা চাপ দিচ্ছে ভাড়ার জন্য। কিন্তু মেয়েগুলো ভাড়া দিবে কোথা থেকে? ওদের তো জমানো টাকাও নেই যে সেখান থেকে ভেঙে টাকা-পয়সা খরচ করে চলবে’, বলেন তিনি।

একমাত্র চাওয়া খাদ্যসহায়তা

অক্ষয় নারী সংঘের সভাপতি জানান, ভাসমান এসব যৌনকর্মীর এখন একমাত্র চাওয়া খাদ্যসহায়তা।

তিনি বলেন, ‘এখন যে ভাসমানদের কাজ করে খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, সেটা মনে হয় সবাই বোঝে। সরকার খাদ্যসহায়তা দিলে হয়তো তারা অন্তত খাবার খেয়ে বাঁচতে পারত।’

‘পেটের দায়ে এসব কাজ করে, কোনো বৈধতা নেই’

সারা দেশে কোনো ভাসমান যৌনকর্মীরই লাইসেন্স নেই বলে জানিয়েছেন অক্ষয় নারী সংঘের সভাপতি।

তিনি বলেন, ‘সারা দেশে যারা ভাসমান যৌনকর্মী আছে, তাদের কারো লাইসেন্স নেই। এরা পেটের দায়ে এসব কাজ করে। কোনো বৈধতা নেই। তবে অনেক ভাসমান আছে, যারা আগে পতিতালয়ে কাজ করত, তাদের লাইসেন্স বা বৈধতা ছিল।

‘যেমন নারায়ণগঞ্জে যে ৩৫০ জন ভাসমান যৌনকর্মী আছে, তাদের বেশির ভাগই আগে নারায়ণগঞ্জ টানবাজার ও নিমতলী পতিতাপল্লিতে ছিল। ১৯৯৯ সালে ব্রোথেল দুইটা উচ্ছেদের পর তারা ভাসমান হয়ে গেল। কারণ তাদের তো পেট চালাইতে হবে। টিকে থাকতে হবে।’

এরা আসে কোথা থেকে?

এসব নারী কীভাবে এই জীবনে আসছেন- জানতে কথা হয় রাজধানী ঢাকার একটি যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘দুর্জয় নারী সংঘের’ সদস্য রাজিয়া সুলতানার সঙ্গে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল দালালের মাধ্যমে মেয়েগুলো বিক্রি হতো। আবার অনেক মেয়ে প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে রাগেরবশত ব্রোথেলে আসত। কোনো কোনো মেয়ের প্রেমিক প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের পতিতালয়ে বিক্রি করে যেত জোর করে সর্দারনির কাছে।

‘তবে বেশ কয়েক বছর যৌনকর্মীদের সংগঠন হওয়ার কারণে ওগুলো আর করতে পারে না পতিতালয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে। এখন স্বেচ্ছায় আসলে আসতে পারে। দালাল বা সর্দারনির মাধ্যমে আসতে পারে না।’

রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘এখন যারা আসে তাদের মধ্যে অনেকে আছে ধর্ষণের শিকার মেয়ে। আবার দেখা যায়, কোনো মেয়ে ছোট চাকরি করে, কিন্তু বেতন-ভাতা ঠিকমতো পায় না, তখন সংসার চালাতে কাছের বান্ধবীর মাধ্যমে এ পথে আসছে। সারা দিন অন্য কাজ করছে, আর রাতের বেলা ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছে।’

একটা পর্যায়ে এসব ভাসমান যৌনকর্মীই পতিতালয়ে চলে যান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন পতিতালয়ে যে সর্দারনি থাকে, তার মাধ্যমে লাইসেন্স নিয়ে নেয়। তখন তারা ফুলটাইম যৌনকর্মী হয়ে যায়।’

দুর্জয় নারী সংঘের সদস্য রাজিয়া জানান, বর্তমানে ঢাকা শহরে ১০ হাজার যৌনকর্মী আছেন, তাদের মধ্যে ৭ হাজার ভাসমান। বাকি ৩ হাজার বিভিন্ন হোটেল ও ভাড়া বাসায় যৌনকাজ করেন।

তিনি বলেন, ‘তবে ফুলটাইম আর ভাসমান, যা-ই হোক এই পেশার কেউ এখন ভালো নেই। আমাদের জন্য একটা কিছু করেন, ভাই। জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

‘ভাসমান যারা আছে, তারা নিজেরাই বের হতে পারে না। আর হোটেল তো বন্ধই। যারা ভাড়া বাসায় যৌনকাজ করে, তারা দুই-একটা কাজ কোনো রকম করতে পারছে। বাকিরা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে।’

এ বিভাগের আরো খবর