১০-১১ বছর আগেও ছোট আকৃতির গরুর চামড়ার দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। মাঝারি আকারের চামড়ার দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা এবং বড় সাইজের চামড়ার দাম ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
এখন সেই চামড়া আকৃতিভেদে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৬০০ টাকায়।
দেশের ট্যানারিশিল্পের অন্যতম উপকরণ কাঁচা চামড়ার মাঠপর্যায়ের সংগ্রহ দামের গত কয়েক বছরের এই চিত্র। কোরবানির চামড়ায় ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার এই দায় প্রতিবছর ট্যানারি মালিক ও চামড়াপণ্য রপ্তানিকারকদের নিতে হচ্ছে।
তবে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় স্বস্তিতে নেই চামড়াশিল্পের মালিকরাও। তাদেরও মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতি। তাদের ক্ষেত্রে সংকট চামড়া লবণজাতকরণের মূল উপকরণ লবণের দাম ও এর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তায়।
আবার চামড়া কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা নিয়েও রয়েছে পরিবেশগত সমস্যা। রপ্তানি করার ক্ষেত্রে আরেক দফা সমস্যায় পড়তে হয়। কেননা, দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই খাতসংশ্লিষ্টদের। ফলে এই পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। যেটুকু হচ্ছে, তাতে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় দাম পাওয়া যাচ্ছে ২০-৫০ শতাংশ কম।
এটিই চামড়াশিল্পের সংকটের মূল কারণ। এ কারণেই দেশে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবছর একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। কিন্তু ইউরোপে রপ্তানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের (আইএসও) সার্টিফিকেট প্রয়োজন। থাকতে হয় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) নামে ইউরোপের আরেকটি শক্তিশালী সংস্থার পরিবেশ স্বীকৃতি সনদও। কিন্তু ট্যানারিশিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে না পারায় এর কোনোটিই নেই বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের। যদিও এই স্বীকৃতি সনদ পেতে আবেদন হয়েছে সেই ২০১৭ সালেই। কিন্তু সবুজ পরিবেশে উৎপাদন মানদণ্ডে সন্তোষজনক অবস্থানে না থাকায় সাড়া পাওয়া যায়নি এই আবেদনে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইএসও ও এলডব্লিউজি কমপ্লায়েন্ট সার্টেফিকেট না পাওয়ার কারণে এখন ওই সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঢুকতে পারছে না।
‘কেউ কেউ নানাভাবে লবির মাধ্যমে চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া ও ইতালির মতো কয়েকটি দেশে এখনও রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না পণ্যের প্রত্যাশিত দাম। সংকটের মূলে রয়েছে এই দুটি সংস্থার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়া।’
তিনি দাবি করেন, ‘এটা যতদিন আমরা না পাচ্ছি, ততদিন চামড়াশিল্পে স্থিতিশীলতা আসবে না। দেশেও চামড়ার প্রকৃত মূল্য নিশ্চিত করা যাবে না।’
রাজধানীর হাজারীবাগে শুকিয়ে যাওয়া চামড়া জড়ো করছেন এক শ্রমিক। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
এই স্বীকৃতি পাওয়ার উপায় কী, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাভারে আমাদের যে শিল্পনগরী, তা পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট হয়নি। কারণ শিল্পনগরীতে সিইটিপি হয়েছে। ডাম্পিং ইয়ার্ডও হয়েছে। কিন্তু এখনও সলিড ওয়েস্ট ডেস্ট্রয় ম্যানেজমেন্টের কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। এটাই আইএসও ও এলডব্লিউজির স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম কারণ। একে কমপ্লায়েন্ট করার মতো উদ্যোগ সরকার বা বিসিককেই নিতে হবে।’
এলডব্লিউজির সনদ পেতে ১৩৬৫ নম্বরের মান যাচাই প্রক্রিয়া হয়। এর মধ্যে বিসিক অর্জন করেছে মাত্র ২০০ নম্বর। যেখানে ১০০ নম্বর সিইটিপি দিয়ে, বাকি ১০০ নম্বর ডাম্পিং ইয়ার্ড দিয়ে। অবশিষ্ট ১১৬৫ নম্বর এখনও বিসিক ও ট্যানারি মালিকদের অর্জন করতে হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রক্রিয়াজাত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম যেখানে ৫ দশমিক ৫০ ডলার থেকে ৬ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৪৬৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৫২৭ টাকার মধ্যে, সেখানে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা দেড় থেকে ২ ডলার বা ১২৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত দাম পাচ্ছেন পরিবেশগত সার্টিফিকেট না থাকার কারণে। অর্থাৎ রপ্তানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্যের ন্যায্য দাম হারাচ্ছেন।
চামড়া রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হলো কেন?
এই যখন অবস্থা, তখন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, বেশ কয়েক বছর পর চামড়া রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে বাংলাদেশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
তবে এ প্রবৃদ্ধি সংকট উত্তরণের কোনো ইঙ্গিত নয় বলে মনে করেন বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, ‘চামড়া রপ্তানিতে আয় বাড়ছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তার নেপথ্যে এই মুহূর্তে দেশীয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ভূমিকা নেই। এই আয় বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে কিছু রপ্তানিকারক কর্তৃক বিদেশি চামড়া আমদানি করে তা দেশীয় ট্যানারিতে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে পুনরায় রপ্তানির উদ্যোগ।’
সাভার বিসিক চামড়া শিল্পনগরী
সংকটের মূলে সিইটিপি?
রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়া ও চামড়াশিল্পে নৈরাজ্যের পেছনে খাতটির কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড না থাকাকেই দায়ী করেন লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চামড়াশিল্পের সুদিন ফেরাতে এবং টেকসই করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রেতা আকৃষ্ট করতে আইএসও এবং এলডব্লিউজির সনদ প্রাপ্তি ছাড়া এই মুহূর্তে কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিতে যেতে হলে এবং ইউরোপের মতো বড় বাজার ধরতে হলে যেকোনোভাবে এই সনদ অর্জন করতে হবে। এই সনদ পেতে মালিকরা যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত। কিন্তু তার আগে তো এই শিল্পনগরীকে আন্তর্জাতিক মানে রূপ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেখানে যেটা করণীয়, সে বিষয়ে বিসিককেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকেও এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে মালিকদের আরও নীতি-সহায়তা দিতে হবে।’
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি মো. আফতাব খান বলেন, ‘কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে সবাই প্রথম অভিযোগের তির ছোড়েন আড়তদারদের দিকে। বলেন, তারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আড়তদাররা কমিশন বিজনেস করেন। কাঁচা চামড়া লবণজাতকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দরে হস্তান্তর করে দেন। ট্যানারি মালিকরা যদি দাম বাড়ান, তাহলে তো মাঠপর্যায়েও বাড়ে চামড়ার দাম। সে ক্ষেত্রে আমরাও চাই শিল্পটি টেকসই হোক। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাক। এর মাধ্যমে দেশেও বাড়ুক দাম। গরিব পাক তার ন্যায্য দাম।’
সাভার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক জিতেন্দ্রনাথ পাল এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চামড়া শিল্পনগরীর কর্তৃপক্ষ বিসিক হলেও সিইটিপি সক্রিয় রাখা তাদের একার দায়িত্ব নয়, ট্যানারি মালিকদের ওপরও এটি নির্ভরশীল। কারণ সিইটিপি সচল রাখতে প্রতিটি কারখানায় একটি সেডিমেন্টেশন ট্যাংক রয়েছে। সেটি মালিকদের সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করতে হয়। নতুবা সিইটিপি সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করে না।’
তিনি বলেন, ‘ডাম্পিং ইয়ার্ড তো হয়েছেই। এর থেকে কঠিন বর্জ্য বা সলিড ওয়েস্টও নিয়মিত অপসারণ করা হচ্ছে। সেখানে সক্ষমতার ঘাটতি আছে। আবার স্থায়ী ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমও হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব এই ঘাটতি বিসিক মেটানোর চেষ্টা করছে। তবে এতে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারেরও সহযোগিতা দরকার।’