বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চারদিকে পানি, সংকট পানীয় জলের

  • আমিনুল ইসলাম, খুলনা   
  • ২৩ জুলাই, ২০২১ ০৮:৪৫

কয়েক দশক ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারীদের অবস্থাও অনেকটা ওই নাবিকদের মতো। এ অঞ্চলের মাটি ও পানিতে কয়েক দশক ধরেই বাড়ছে লবণাক্ততা। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে এখানে।

‘সব জায়গায় পানি, এক ফোঁটা পানি নেই পান করার’- ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য রাইম অফ দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’-এর একটি পঙক্তি। সমুদ্রে পথ হারানো নাবিকের অবস্থা বর্ণনায় এটি বলা হয়।

কয়েক দশক ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারীদের অবস্থাও অনেকটা ওই নাবিকদের মতো। এ অঞ্চলের মাটি ও পানিতে গত কয়েক দশক ধরেই বাড়ছে লবণাক্ততা। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে এখানে।

উপকূলের এসব এলাকায় সারা বছরই থাকে পানীয় জলের অভাব। শুষ্ক মৌসুমে পানি আনতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে। একবিংশ শতাব্দীতেও পুকুর থেকে পানি এনে তা ফুটিয়ে পান করা হয় অনেক স্থানে।

এ ছাড়া লবণাক্ততার কারণে নিয়মিত ফসলি জমি হারাচ্ছেন কৃষকরা। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নারীরা। শিশুদের শরীরেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

খুলনার লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ জানতে ১৯৭৩ সালে প্রথম জরিপ চালায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)।

সেই জরিপে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় ১৮টি জেলার ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরের মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ত। প্রথম জরিপের ২৭ বছর পর ২০০০ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় জরিপ চালায় সংস্থাটি।

২০০০ সালের জরিপে দেখা যায়, লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টরে। ২০০৯ সালের জরিপে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। সব মিলিয়ে এই ৩৬ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ৭ ভাগ।

২০২০ সালে চতুর্থ জরিপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে তা হয়নি। সেই জরিপ হয়েছে ২০২১ সালে। ৬ মাস পর এ জরিপের ফল প্রকাশ করা হবে।

এ ছাড়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতি মাসে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলার ১৭টি পয়েন্ট থেকে মাটি এবং ১৩টি নদীর পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা করে।

২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ পরীক্ষার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারি থেকে নদীর পানিতে লবণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। মে মাসে এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। মাটিতে লবণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে এপ্রিলে।

দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্র নাথ জানান, লবণাক্ততার সহনশীল মাত্রা প্রতি ঘনমিটার পানির জন্য ০.৭৫ ডেসি সিমেন (ডিএস) এবং মাটির জন্য ২ ডিএস। মাটিতে লবণাক্ততা ৪ ডিএসের বেশি থাকলে ফলন কমে। ৪ থেকে ৮ ডিএস পর্যন্ত ফলন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। প্রতি ঘনমিটারে লবণের পরিমাণ ১২ ডিএসের ওপরে গেলে ফসল আশা করা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম হয়।

একইভাবে পানিতে লবণের পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ২ ডিএসের নিচে থাকলে সেচ দেয়া যায়। ২ থেকে ৪-এর মধ্যে থাকলে সব ফসলে সেচ দেয়া যায় না। ৪-এর ওপরে গেলে এই পানি সেচকাজে ব্যবহার করা যায় না।

জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খুলনার রূপসা নদীতে মে মাসে গড়ে লবণাক্ততা ছিল ১৮ দশমিক ৫৬ ডিএস। শোলমারী নদীর কৈয়া বাজার পয়েন্টে গড়ে ১৮ দশমিক ৩৭, ডুমুরিয়ার ভদ্রা নদীতে ২১ দশমিক ৯৬, সাতক্ষীরার বেতনা নদীতে ২০ দশমিক ৯৮ ও পাইকগাছার শিবসা নদীতে ২৬ দশমিক ৬৪ ডিএস প্রতি ঘনমিটারে।

মাটিতে এই লবণাক্ততা বটিয়াঘাটার কৃষ্ণনগরে এপ্রিল মাসে গড়ে ৬ দশমিক ৪৮ ডিএস মিটার, মোংলা উপজেলার দিগরাজে ২০ দশমিক ৭৩, পাইকগাছার শিববাড়ি এলাকায় ১৩ দশমিক ৯৬।

মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে আশির দশকে নদীর পানি কৃষিজমিতে এনে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। বর্তমানে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের এক লাখ ৪৫ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। সেই হিসাবে নদী ও খালের পাশাপাশি এই এলাকার বিপুল পরিমাণ জমি এই মুহূর্তে লবণ পানির নিচে রয়েছে।

পরিবেশবিদরা জানান, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার স্থায়ীভাবে চেপে বসেছে। উজানের পানি কমে যাওয়া, নদী ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে।

লবণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মিঠা পানির চরম সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত ফসলি জমি হারাচ্ছেন কৃষক। এ ছাড়া নারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর শরীরেও থাকছে লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাব।

কয়রার কাশিয়ানি হাটখোলার গৃহিণী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘চারদিকে পানি তবে মিঠা পানির অভাব। শুষ্ক মৌসুমে দূর-দূরান্ত থেকে পুকুরের পানি আনতে হয়। পরে সেই পানি ফুটিয়ে পান করি। তবে বর্ষা মৌসুমে মিঠা পানির সংকট কম থাকে।’

দাকোপের গৃহিণী রিতা রানী জানান, প্রায়ই তার পেটে সমস্যা থাকে। সারা দিন লবণ পানিতে কাজ করায় তার চামড়ায় সাদাটে ঘা হয়ে গেছে।

দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা অন্তঃসত্ত্বা শিউলী বেগম জানান, লোনা পানির কারণে এর আগে তার ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যায়। এবার ভয়ে ভয়ে আছেন। তাই চিকিৎসকের কাছে এসেছেন।

কয়রার কাশিয়ানি হাটখোলা এলাকার গৃহিণী রাফিজা জানান, তার পাঁচ বছরের ছেলে মাসুম জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। হাঁটতে পারে না ও কানেও শুনতে পারে না।

খুলনা সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, দীর্ঘদিন লোনা পানি ব্যবহারে ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ ও গর্ভকালীন নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, সমুদ্র উপকূলে দুর্বল বাঁধগুলো মেরামত ও উঁচু করার জন্য নতুন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া লবণ চাষ বা চিংড়ির জন্য বাঁধ কেটে কেউ যাতে নোনাপানি প্রবেশ করাতে না পারে সেজন্য অভিযান চলছে। স্লুইস গেট দিয়ে পানি আসা-যাওয়া তদারকি করেছে পানি ব্যবস্থাপনা দল।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমান বলেন, ‘খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় ৯টি উপজেলার ৫২টি ইউনিয়নকে আমরা বেশি লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছি। এসব জায়গায় আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পুকুর খনন করেছি।

‘এ ছাড়া যে স্থানে নলকূপে মিঠা পানি পাওয়া যায় না, সেখানে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। মোংলায় একটি পানি পরিশোধন কেন্দ্রও করা হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর