বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিলেটের শ্রীমুখ কি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম?

  •    
  • ২১ জুলাই, ২০২১ ২০:০৭

গ্রামের আয়তন মাত্র ৬০ শতক। লোকসংখ্যা মোট চার জন, যারা সবাই একই পরিবারের সদস্য। এর মধ্যে পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে। বাকি তিন জনের মধ্যে দুজন নারী ও একজন শিশু। সবশেষ ভোটার তালিকায় এই গ্রামে ভোটার আছেন দুজন।

চারপাশে ধানি জমি। ফাঁকে ফাঁকে জলমগ্ন ডোবা। ডোবা আর ধানক্ষেত পেরোলে বাঁশবাগান-ঝোপঝাঁড়। কোনো রাস্তা নেই। ক্ষেতের আলপথ ধরে বাঁশবাগান পেরিয়ে সামনে গেলেই দেখা মেলে একটি বাড়ির।

বড় উঠানের শেষ প্রান্তে টিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি সাধারণ ভাঙাচোরা ঘর। দারিদ্রের স্পষ্ট ছাপ থাকা এই বাড়ি নিয়েই গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম। নাম শ্রীমুখ। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডে অবস্থান এই গ্রামের।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর নথি ও ভোটার তালিকাতেও রয়েছে একটি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এই গ্রামের নাম। শ্রীমুখ দেশের তো বটেই, এমনকি বিশ্বের ‘সবচেয়ে ছোট গ্রাম’ বলে দাবি করছেন গবেষকেরা।

সরকারি নথিতে অবশ্য সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে আলাদা করে শ্রীমুখের উল্লেখ নেই। তবে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, নথিপত্র ঘেঁটে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে শ্রীমুখের এই স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ নেয়া হবে।

কোথায় শ্রীমুখ

সিলেটের একেবারে পশ্চিমের উপজেলা বিশ্বনাথ। প্রবাসীবহুল এলাকা হিসেবে পরিচিত হলেও এখানকার বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। উপজেলা সদর থেকে রামপাশা হয়ে ২০ মিনিট এগোলেই পৌঁছানো যাবে খাজাঞ্চি ইউনিয়নের শ্রীমুখ গ্রামে। তেলিকোনা ও পশ্চিম নোয়াগাও নামে দুটি গ্রামের মাঝখানে অবস্থান শ্রীমুখের।

গ্রামের আয়তন মাত্র ৬০ শতক। লোকসংখ্যা মোট চার জন, যারা সবাই একই পরিবারের সদস্য। এর মধ্যে পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে। বাকি তিন জনের মধ্যে দুজন নারী ও একজন শিশু। সবশেষ ভোটার তালিকায় এই গ্রামে ভোটার আছেন দুজন।

পরিসখ্যান ব্যুরোর নথিতে শ্রীমুখ গ্রামের উল্লেখ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এই দপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের উপ পরিচালক মুহাম্মদ আতিকুল কবীর। তিনি বলেন, ‘সবশেষ জরিপ অনুসারে বিশ্বনাথের শ্রীমুখ গ্রামে একটি পরিবার রয়েছে, আর লোকসংখ্যা ৪ জন।’

সবচেয়ে ছোট গ্রাম

আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকলেও গবেষকরা মনে করছেন, আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক দিয়ে শ্রীমুখই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম।

এই গ্রাম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি মৌজা নিয়েই শ্রীমুখ গ্রাম। দাগ, খতিয়ান এবং মৌজাসহ সরকারি সব নথিপত্রে শ্রীমুখ আলাদা গ্রাম হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। এর আয়তন ৬০ শতক, ফলে এটি দেশের পাশাপাশি বিশ্বেরও সবচেয়ে ছোট গ্রাম।’

তিনি বলেন, ‘এখন বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম ধরা হয় ক্রোয়েশিয়ার ‘হাম’-কে। সেখানকার জনসংখ্যা ৩০ জন। হাম আয়তনের দিক থেকেও শ্রীমুখের চেয়ে অনেক বড়।’

তবে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা গেছে, হামকে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট শহর হিসেবেও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

ড. জহিরুল হক শাকিল নিজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে শ্রীমুখের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এতে এই গ্রামের পরিচিত বাড়বে। পর্যটকদের জন্যও গ্রামটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।’

বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই গ্রামটির ব্যাপারে আমি শুনেছি। সম্প্রতি বিশ্বনাথের সহকারী কমিশনার (ভূমি) গ্রামটি পরিদর্শন করেছেন। আমরা এখন বিভিন্ন নথিপত্র জোগাড় করছি। তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে শ্রীমুখের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করা হবে।’

এ প্রসঙ্গে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যে এটি আলাদা গ্রাম হিসেবেই উল্লেখ আছে। এই গ্রামে মাত্র একটি পরিবার রয়েছে।’

ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া কিছুটা ঝামেলার এবং অনেক সময়সাপেক্ষ। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা এলে এটি দ্রুততম সময়ে সম্ভব হবে। আমাদের পক্ষেও তখন কাজ করতে সুবিধা হবে।’

তবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ইতোমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন জানিয়ে বিশ্বনাথ উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম নুনু মিয়া বলেন, ‘আমি পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে এ গ্রাম নিয়ে কথা বলে এসেছি। কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে শ্রীমুখ গ্রামের স্বীকৃতি আদায় করা যায় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তাকে অনুরোধ করেছি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।’

শ্রীমুখ গ্রামের অস্পষ্ট ইতিহাস

শ্রীমুখ গ্রামে এখন বসবাস করে সৌদি প্রবাসী আপ্তাব আলীর পরিবার। আপ্তাব আলীর স্ত্রী, সন্তান ও বোন থাকেন গ্রামের একমাত্র বাড়িটিতে। এর আগে বাড়িটি ছিল একটি হিন্দু পরিবারের।

তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৪ সালে হিন্দু পরিবারটি আপ্তাব আলীর দাদা হাবিব উল্লাহর কাছে বাড়ি ও জমি বিক্রি করে ভারতে চলে যায়। দাদার কাছ থেকে এই বাড়ি পান আপ্তাব আলী।

ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় আপ্তাব আলীর স্ত্রী রাহিমা বেগমের সঙ্গে। গ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। বিয়ের পর থেকেই এ বাড়িতে বসবাস করছেন বলে জানান রহিমা।

রহিমা বেগম বলেন, ‘আমরার একটা বাড়ি লইয়াই আমরার গ্রাম। এক বাড়ি লইয়া কিলা গ্রাম অইলো ইটা আমি জানি না।’

স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা খাজাঞ্চি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আইনজীবী আব্দুর রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুনেছি ব্রিটিশ আমলে এখানে একটি হিন্দু পরিবার বসবাস করতো। পরে তারা অন্যত্র চলে যায়। এসময় পাশের পশ্চিম নোয়াগাওঁ গ্রামের আব্দুল গনির পিতা মরহুম হাবিব উল্লাহ এই বাড়িটি ক্রয় করেন। পরে শ্রীমুখ গ্রামের বাড়িটি হাবিব উল্লাহ তার মেয়ে কটাই বিবিকে দান করেন। এরপর কটাই বিবি স্বামী আব্দুল রহমানকে নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। কটাই বিবি ও তার স্বামী মারা যাওয়ায় পর ছেলে আপ্তাব আলীর পরিবার বর্তমানে এ বাড়িতে আছে।

অধ্যাপক জহিরুল হক শাকিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামটির আয়তন আগে হয়তো অনেক বেশি ছিলো। সম্ভবত নদীভাঙনে কিছু এলাকা তলিয়ে গেছে। অন্য গ্রামের লোকদের কাছে বিক্রি করার ফলে এই গ্রামের জায়গা অন্য গ্রামের অন্তর্ভুক্তও হয়ে যেতে পারে। এছাড়া আগে এখানে একাধিক পরিবারও বসবাস করে থাকতে পারে। তবে ১৯৬৪ সালের পাওয়া হিসাবে এখানে একটি পরিবারই ছিল।’

শ্রীহীন শ্রীমুখ

গ্রামে যেতে নিজস্ব কোনো রাস্তা নেই। হেমন্তে অন্যের জমির আলপথ পেরিয়ে, আর বর্ষায় কিছুটা নৌকায় করে ও কিছুটা কাদামাটি পেরিয়ে যেতে হয় শ্রীমুখ গ্রামে।

আপ্তাব আলীর স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়িত ঢুকার কোনো রাস্তা নাই। আরোকজনোর জমিনোর উপর দিয়া আইতে অয়। বাইচ্চার স্কুলো যাইতে খুব সমস্যা অয়। আর বর্ষার সময় তো পানিত বন্দি থাকি।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘একটামাত্র বাড়ি হওয়ায় আমরার গ্রামোর উন্নয়নোর কথা কেউ জিন্তা করইন না।’

গ্রামটির দুরবস্থা প্রসঙ্গে খাজাঞ্চি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার মো. গিয়াস উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামের একটিমাত্র বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছেছে। তাদের প্রধান সমস্যা এখন নিজস্ব সড়ক না থাকা, তবে বাড়ির চাপাশে অন্যের ব্যক্তিমালাকাধীন জমি থাকায় চাইলেই সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব নয়।’

ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘জমির মালিকরা যদি একটু জমি ছেড়ে দেন তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সড়ক তৈরি করতে উদ্যোগ নেব।’

এ বিভাগের আরো খবর