গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দেবগ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্প। ভূমি ও গৃহহীন ৫০টি পরিবারের ঠাঁই হয়েছে এখানে।
এই প্রকল্প এলাকায় রয়েছে উন্নত জীবন যাপনের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। এমন তথ্য যাচাই করতে কয়েক দিন আগে সেখানে যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক।
প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি পৌঁছাতেই লাল টিনের সেমিপাকা ঘর নজরে আসে। আশ্রয়ণের পাশেই খাল, সেই খালের শান্ত জলে সাজানো ঘরগুলোর প্রতিচ্ছবি।
কাঠের সাঁকো দিয়ে সেই ছবি দেখতে দেখতে প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ। খালপাড়ের পাকা ঘাটলায় নারীদের ব্যস্ততা। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি শীতল জলে গা জুরিয়ে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বাসিন্দাদের বসার জন্য পাকা বেঞ্চের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো হয়েছে এই গাছ।
পাশেই পার্কের আদলে বাচ্চাদের জন্য খেলার জায়গা। সেখানে দোলনায় শূন্যে ভাসার আনন্দ উপভোগ করছে ছেলে-মেয়েরা। তাদের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ছে প্রকল্প এলাকাজুড়ে।
মনোহর সেই দৃশ্যে প্রতিবেদককে টেনে নেয় অতীতে। ঘোর কাটতে না কাটতে নজরে আসে লাইব্রেরি। নাম তার ‘আলোর ঘর’।
ঘরের মধ্যে টেবিল-চেয়ার সাজানো। সেখানে বসে বই পড়ছেন কয়েকজন। তারা জানান, এই পাঠাগারে বই আছে মোট ৬৭টি। এর মধ্যে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যাই বেশি।
লাইব্রেরির পাশে রয়েছে বৈঠক করার মতো জায়গা। পাকা বেঞ্চ-টেবিলে বসে সেখানে গল্পে মাতেন বাসিন্দারা।
এই প্রকল্পে ঘর পেয়েছেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বৃদ্ধ অনিল দাস ও তার স্ত্রী সুমালা দাস। এই দম্পতিকে দেখা যায় ফুরফুরে মেজাজে গল্প করতে। কেমন আছেন, প্রশ্ন করতেই গল্পের ডালি খুলে বসেন অনিল।
তিনি বলেন, ‘বাবা অনেক ভালো আছি। শেখ হাসিনা এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে শেষ বয়সে জায়গা দিয়ে একটা পাকা ঘর করে দিয়েছেন, ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছেন। পাকা পায়খানা, সুপেয় জলের সুবিধা দিয়েছেন। স্নানের জন্য খালপাড়ে পাকা ঘাটলাও করে দিয়েছেন। মা-বাবা যা দিতে পারেননি, সারা জীবন আয় রোজগার করে যা করতে পারিনি, সেই কাজটি আমার আরেক মা শেখ হাসিনা করে দিয়েছেন।’
আরেক বাসিন্দা শারীরিক প্রতিবন্ধী আরিকুল মোল্লা বলেন, ‘স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে অন্যের জমিতে ঝুপড়িতে থাকতাম। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার হিসেবে একটি ঘর বরাদ্দ পেয়েছি। নতুন ঠিকানায় স্ত্রী পরিজন নিয়ে অনেক সুখেই আছি আমরা।’
বাবা-মা বা অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন নেই জরিনা বেগমের। তিনি আগে থাকতেন কোটালীপাড়া সদরে। নতুন ঠিকানা পেয়ে দারুণ খুশি জরিনা। তিনি বলেন, ‘এখন এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারাই আমার আত্মীয়স্বজন। সবাই আমরা মিলেমিশে একই পরিবারের সদস্যের মতো বসবাস করছি। একজনের সুখে-দুঃখে অন্যজন এগিয়ে আসেন। এখন আমার ঠিকানা আছে। আমি বলতে পারি, আমি দেবগ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা। আমার ঘর নম্বর ৪। আমাকে যে কেউ খুঁজলেই পাবে।’
ছায়া রানী বিশ্বাস বলেন, ‘স্বামী সুবল বিশ্বাস ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। পাঁচ মেয়ে রেখে সাত বছর আগে মারা যান তিনি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে জায়গাসহ ঘর দিয়েছেন, তাতে আমার মহা উপকার হয়েছে। বুড়ো বয়সে থাকার একটা ঠিকানা হলো। নতুন ঠিকানার সুন্দর পরিবেশ আমার অনেক ভালো লাগছে।
‘এখানে ছেলেমেয়েদের জন্য লাইব্রেরি, খেলার জন্য দোলনা, বসার স্থান, পাশে রয়েছে নদী ও বিল। অবসরে যখন ঘুরতে বের হই, তখন মনটা ভালো হয়ে যায়।’
জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখানে বসবাসকারীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা দেবার চেষ্টা করেছি। এখানে আমরা যেসব সুবিধা দিয়েছি, পর্যায়ক্রমে জেলার অন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেব। যাতে আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীরা একটা উন্নত জীবন পায়। নতুন প্রজন্ম যেন একটি সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠতে পারে।’
দেশে একজনও গৃহহীন থাকবে না, সরকারের এমন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় প্রথম দফায় ২৩ জানুয়ারি ৬৬ হাজার গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় আরও ৫৩ হাজার ৩৪০ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে দেয়া হয় ঘর।