গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে মাঠের রাজনীতিবীদদের খুব একটা প্রাধান্য দেয়নি কোনো দলই। দেশের সবচেয়ে পুরনো দল আওয়ামী লীগও এর বাইরে নয়। বরং পরিচিত মুখ বা প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পেশার মানুষদের সংসদ সদস্য করতে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল।
জাতীয় নির্বাচনের পর বিভিন্ন সময় সংসদ সদস্যদের মৃত্যুর পর যে আসনগুলো খালি হয়েছিল, সেখানেও দেখা গেছে প্রয়াত সংসদ সদস্যদের পরিবারের সদস্যদের প্রাধান্য।
তবে সম্প্রতি সে ধারায় দেখা যাচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। উপনির্বাচন তো বটেই এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও দলের ত্যাগী ও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদেরই সামনে নিয়ে আসছে দলটি। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দলের জন্য ত্যাগ না করলে কোনো পর্যায়ের নির্বাচনেই আর মনোনয়ন পাওয়া যাবে না।
দেশে সবশেষ অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও প্রার্থিতার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিতে নেই এমন নেতাদের আধিক্য। নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্যদের ১৪৭ জনই হলফনামায় নিজেদের সরাসরি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেন। আর পেশা হিসেবে কৃষি ও ব্যবসা পরিচয় দেন ৩৬ জন। এ হিসেবে মোট সংসদ সদস্যদের ৬১ ভাগই ব্যবসা পেশার সঙ্গে জড়িত। বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে ১৩ শতাংশ আইনপেশার। শুধু রাজনীতি হিসেবে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন মাত্র ৭ শতাংশ সংসদ সদস্য। এর আগের নির্বাচনগুলোতেও চিত্র ছিল প্রায় এক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদের মতে, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের সময় দল ভারি করতে অর্থ ও বিত্তবানদের হাতে রাজনীতি ছেড়ে দেয়া হয়। টিকে থাকতে আওয়ামী লীগও সেই ধারায় নিজেদের মানিয়ে নেয়।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের মধ্যে সৃষ্ট দল। সারা দেশে এই সংগঠনের লাখ লাখ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী রয়েছে। তাদের বঞ্চিত করে হঠাৎ করে কোনো ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো পেশার মানুষকে নমিনেশন দেয়া এটা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
‘বঙ্গবন্ধুর সময়ও আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ যাদের টাকা পয়সা নেই তাদেরও নমিনেশন দিয়েছে। দেশের রাজনীতিতে এ ধারার পরিবর্তন দেখা যায় সামরিক শাসনের সময় থেকে। চালু হলো “মানি ইজ নো প্রবলেম” সংস্কৃতি। এটি মূলত টাকার খেলা। টাকা দিয়ে দল ভাঙা এবং দল সৃষ্টি করা। এখানেই রাজনীতিতে দূষণ সৃষ্টি হয়েছে। সেটার মধ্যে পরে রাজনীতিতে যে প্রতিযোগিতা ছিল সেই সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়। মাসল এবং মানির অপসংস্কৃতি তৈরি হয়। এর প্রতিফলনই পরবর্তীতে দেখা যায়।’
অধ্যাপক হারুন বলেন, ‘২০০০ সালের পর রাজনীতিতে সরকার ও বিরোধীদলের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানও আমরা দেখি না। রাজনীতি তো করবে রাজনীতিবিদরা, ব্যাকরণে এটাই বলে। কিন্তু আমলা বা ব্যবসায়ীদের হাতে রাজনীতি থাকার কথা না। কিন্তু তাদের হাতে যদি রাজনীতি চলে যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের যে চরিত্র সেটি কিন্তু আর থাকে না।’
সম্প্রতি জাতীয় সংসদের তিনটি আসনে উপ নির্বাচনে তৃণমূল নেতাদের বেছে নেয় আওয়ামী লীগ। ঢাকা-১৪ আসনে মনোনয়ন পান আগাখান মিন্টু (বাঁয়ে), কুমিল্লা-৫ আসনে আবুল হাসেম খান (মাঝে) ও সিলেট-৩ আসনে হাবিবুর রহমান
সাম্প্রতিক সময়ে এ ধারা থেকে বেড়িয়ে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে মাঠের রাজনীতিবীদদেরই প্রাধান্য দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। সবশেষ ঢাকা-১৪, কুমিল্লা-৫ ও সিলেট-৩ আসনে উপনির্বাচনে তৃণমূলের কর্মীদের উপরই আস্থা রাখতে দেখা গেছে দলটিকে। এই তিন আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আগাখান মিন্টু, আবুল হাসেম খান ও হাবিবুর রহমান তৃণমূল থেকে রাজনীতি করা নেতা।
এর মধ্যে মিরপুরের শাহ আলী থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি আগাখান মন্টু প্রায় ৫০ বছর ধরে দলের রাজনীতি করছেন। তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবুল হাসেম খানও অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে স্থানীয় পর্যায়ে দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। আর হাবিবুর রহমান খানও তেমন বড় কোনো মুখ নন।
আসলামুল হক আসলামের মৃত্যুর পর ঢাকা-১৪, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে সিলেট ৩ ও আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে কুমিল্লা-৫ আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়।
এই তিন উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে ঢাকা-১৪ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন ৩৩ জন, কুমিল্লা-৫-এ ৩৫ এবং সিলেট-৩-এ ২১ জন, যার মধ্যে প্রয়াত সংসদ সদস্যদের পরিবারের সদস্যসহ অন্য পেশার অনেকেই ছিলেন।
এর আগে অনুষ্ঠিত পাবনা-৪, ঢাকা-৫, নওগাঁ-৬, ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী করা হয়েছিলো নুরুজ্জামান বিশ্বাস, কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, আনোয়ার হোসেন হেলাল ও হাবিব হাসানকে।
পাবনা-৪ আসনে ১৯৯৬ সাল থেকে টানা ২৪ বছর আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। তার মৃত্যুর পর ডিলুর পরিবারের অন্তত আট সদস্য উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয় পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুরুজ্জামান বিশ্বাসকে।
একইভাবে ঢাকা-৫ আসনের দীর্ঘদিনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যু হলে এতে প্রার্থী করা হয় যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম মনুকে। নওগাঁ- ৬ এ আনোয়ার হোসেন হেলাল ও ঢাকা-১৮ তে মনোনয়ন পান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসান। এর বাইরে যশোর-৬ এ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও গাইবান্ধা-৩ আসনে কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি।
অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এটি নিয়ে অনেক কথাবার্তাও হয়েছে। আমার ধারণা দলের অভ্যন্তরেও আলোচনা-সমালোচনা আছে। বলা যেতে পারে, এটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হয়তো আমলে নিয়েছেন। আর এ কারণেই সাধারণ নির্বাচনেও যেখানে অন্য পেশার মানুষকে নমিনেশন দেয়া হয়েছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে একেবারে মাঠের রাজনীতি যারা করেছেন বা মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছেন, অর্থবিত্ত নাই কিন্তু নিষ্ঠা আছে, ত্যাগ আছে, তাদের নমিনেশন দেয়া হচ্ছে উপনির্বাচনে।
‘এটা একটা ইতিবাচক দিক। এটাই হওয়া উচিৎ, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগে এটাই হওয়ার কথা। দলের এ সিদ্ধান্তের কারণে তৃণমুলেও ভালো বার্তা যাবে।’
উপনির্বাচনের বাইরেও সম্প্রতি যে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেগুলোতেও ত্যাগী নেতাদেরই এগিয়ে নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ বলছে, ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা সাম্প্রতিক বিষয় না। সব সময়ই আওয়ামী লীগে তৃণমুলের মাঠকর্মীদের, দুর্দিনের-দুঃসময়ের মাঠকর্মীদের, সৎ, জনপ্রিয়দের প্রাধান্য দেয়া হয়। এটা নতুন কিছু না। এটা আওয়ামী লীগের হেরিটেজ। এটাকে ধরে রেখেই আওয়ামী লীগ এতো ঘাত-প্রতিঘাতের পরেও টিকে আছে।
‘এই প্রাধান্য সব সময় থাকবে। আগামী দিনে আরো বেশি করে দেয়া হবে, এটা তারই শুভ ইঙ্গিত বলতে পারেন। এটা সব পর্যায়ের নেতৃত্ব কিংবা নির্বাচনের ক্ষেত্রেই বলবৎ থাকবে।’