কাজের সুযোগ নেই, আশপাশে বাজার নেই। ঘরে বিদ্যুৎ, পানির ব্যবস্থা নেই। আছে নিরাপত্তার সংকট। তাই সরকারের দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ছেড়ে দিতে চান তারা।
বুধবারই এ খবর জানিয়েছে নিউজবাংলা। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ইকরতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী ৮টি পরিবার ঘর ছেড়ে দেয়ার আবেদন করেছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
তবে বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে নিউজবাংলার প্রতিবেদক জানতে পারেন, আটটি নয়, ঘর ছাড়ার আবেদন করেছে অন্তত ১৮টি পরিবার।
যদিও উপজেলা প্রশাসন থেকে এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে প্রশাসন।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, ১৮টি পরিবার ঘর ফেরত দিতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছে। তবে এমন তথ্য দেয়া কেউই নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা জানি ঘর ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ১৮ জন লোক আবেদন করেছেন। কর্মসংস্থান নেই, রাস্তা ভালো না। এখানে নিরাপত্তারও অভাব রয়েছে। তাই তারা এখানে আসতে চান না।’
অভিযোগ উঠেছে, ভূমিহীন নয়, বরং বাড়িঘর থাকা অনেক পরিবার এখানে ঘর পেয়েছে। এ কারণে তারা থাকছে না।
- আরও পড়ুন: উপহারের ৮ ঘর ফিরিয়ে আবার গৃহহীন
বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে নিউজবাংলা। ইকরতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, ৭৪টি পরিবারের মধ্যে সেখানে ৪৯টি ঘরে লোকজন রয়েছেন। বাকি ঘরগুলোতে তালা ঝুলছে।
আবার যে ৪৯টি ঘরে লোকজন রয়েছেন সেগুলোর অধিকাংশতেই নেই কোনো আসবাব। বিছানা, পোশাক-আশাক থাকা তো দূরের কথা, নেই রান্নার হাঁড়ি-পাতিলও। অধিকাংশ ঘরেই একজন বয়স্ক নারী ছাড়া কাউকেই পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, এখানে ৩৫টির বেশি পরিবার থাকে না। বৃহস্পতিবার সকালে ওই স্থানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে উপজেলা সহকারী কমিশনার আসার কারণে লোকজন এসেছেন।
সরেজমিনে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাইলে রহস্যজনক কারণে কেউই রাজি হননি। একপর্যায়ে কথা বলতে এগিয়ে আসেন কয়েকজন।
এর মধ্যে ষাটোর্ধ্ব নারী নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী রিকশা চালাইন। ইখান (এখানে) আওয়ার (আসার) রাস্তা বালা না। তাই অনেক সমস্যা হয়। এ ছাড়া ইখান কোনো কামকাজ নাই। অনেক কষ্ট কইরা আমরার চলন লাগে।’
তিনি বলেন, ‘যারার অন্য জায়গাত থাকার জায়গা আছে তারা ইখান থাইক্কা গেছেগা। আমরার যাওয়নের জায়গা নাই। এর লাগি যাই না। কিতা আর করমু, কষ্ট কইরা থাকি।
‘ইখান থাইকা বাজার অনেক দূর। তিন কিলোমিটার দূরে গিয়া বাজার করন লাগে। রাস্তাও বালা না। কয়দিন ধইরা আমি পান খাইতা পারতাছি না। মুখটা কেমন কেমন লাগে। অখন পান আনতে অমরোড বাজার যাওয়ন লাগে। ২০ টেকার পান আনতে ৪০-৫০ টেকা গাড়ি বাড়া লাগব।’
এদিকে উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ওই স্থানে ৭৪টি পরিবারের মধ্যে ৫৬টি ঘরে লোকজন রয়েছেন। ১৮টি পরিবার সেখানে ওঠেনি। এর মধ্যে কয়েকটি পরিবার ঘরগুলো ফেরত দিতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছে। তবে কতটি পরিবার ঘর ফেরত দিতে আবেদন করেছে তার সংখ্যা জানায়নি উপজেলা প্রশাসন।
চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সত্যজিত রায় দাশ বলেন, ‘সেখানে ৫৬টি পরিবার বসবাস করছে। তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। পানির জন্য ১৬টি টিউবওয়েল বসানোর কাজ চলছে। এ ছাড়া নিয়মিত তাদের ত্রাণ দেয়া হচ্ছে।’
১৮টি ঘর খালি থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা কালেঙ্গা বনাঞ্চলে থাকে। তারা সেখান থেকে আসতে চাচ্ছে না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন একটি পরিবারও ভূমিহীন/গৃহহীন থাকবে না। তাই যারা এখানে আসতে চাচ্ছেন না বা ঘর ফেরত দিতে আবেদন করেছেন, তাদেরকে কালেঙ্গায় ঘর বানিয়ে দেয়া হবে।’
এ ব্যাপারে আহম্মদাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আবেদ হাসনাত চৌধুরী সনজু বলেন, ‘মানুষজন কীভাবে থাকবে? এখানে কোনো কর্মসংস্থান নেই। তিন কিলোমিটারের আশপাশে কোনো বাজার নেই। কাজ না থাকলে এখানে ঘর পেয়ে কী লাভ? এ কারণে তারা থাকতে চান না।’
তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জায়গা সিলেকশনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। উপজেলা প্রশাসন একক সিদ্ধান্ত নিয়ে এই জায়গাটি সিলেকশন করেছে। জায়গা সিলেকশনে ভুলের কারণে এমনটা হয়েছে।’
উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির লস্কর বলেন, ‘চুনারুঘাট উপজেলায় যে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে তা আর কোথাও হয়নি। কোথাও একটি ঘর নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে দেখাতে পারবেন না। এখন লোকজন না থাকলে আমাদের কী করার আছে।’
তিনি বলেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘরগুলো নির্মাণ এবং হস্তান্তর করতে হয়েছে। এ ছাড়া প্রথম অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের শর্ত ছিল শুধু ‘ক’ শ্রেণিভুক্তদের এখানে ঘর দেয়া হবে, যে কারণে ‘ক’ শ্রেণিভুক্তদের দিতে গিয়ে এই সমস্যাটা হয়েছে।
‘এখন আবার মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়ছে ভূমিহীন যে কাউকে ঘর বরাদ্দ দেয়া যাবে। এখন যারা ঘর ছেড়ে দিচ্ছেন তাদের বরাদ্দ বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই নতুনদের ঘর বরাদ্দ দেয়া হবে।’
উপহারের ঘর: উচ্ছ্বাস থেকে ক্ষোভ
দেশে একজনও গৃহহীন থাকবে না, এমন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মানসম্পন্ন ঘর নির্মাণ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার পর প্রশংসিত হয়েছে।
প্রথম দফায় ২৩ জানুয়ারি ৬৬ হাজার গৃহহীন পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় আরও ৫৩ হাজার ৩৪০ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে দেয়া হয় ঘর।
প্রথম পর্বে ঘর নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সে সময় বেশ কিছু এলাকায় ঘর নির্মাণে ত্রুটির সংবাদ আসার পর স্থানীয় প্রশাসনের দাবির মুখে দ্বিতীয় পর্বে ঘর নির্মাণে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয় ২০ হাজার টাকা।
তবে প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বের ঘরগুলোতে অনিয়মের তথ্য আসছে বেশি।
নির্মাণের সময়েই ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিক এলাকায়। কোথাও কোথাও পিলার ভেঙে গেছে, কোথাও কোথাও দেয়ালে বিশাল ফাটল ধরেছে, কোথাও কোথাও মাটি ধসে গেছে বৃষ্টিতে। পলেস্তারা খসে পড়ার কথা বলছেন উপকারভোগীরা।
এই ঘরগুলো বরাদ্দ দেয়ার সময় মানুষ আপ্লুত হয়েছেন, গৃহহীনরা তাদের সারা জীবনের আশ্রয়হীনতার দুঃখ ভুলে কিছুটা হলেও স্বাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবন পার করার স্বপ্ন দেখার কথা জানিয়েছেন। তবে এসব ঘরের অনেকগুলোর করুণ চিত্রে মানুষ আবার ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর সেটি সামাজিক মাধ্যমে তারা প্রকাশও করছেন।
বেশ কিছু এলাকার ঘরের দুর্দশার খবর গণমাধ্যমে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পঁচটি দল গঠন করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয় গত শনিবার। দলগুলো ফিরে এসে প্রতিবেদনও দিয়েছে। তবে এখনও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।