নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ আগুনে নিহতদের বেশির ভাগই শিশু। এ ঘটনার পর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, শুধু হাশেম ফুড কারখানা নয়, রূপগঞ্জের আরও অনেক কারখানার বিরুদ্ধে রয়েছে শিশুশ্রমিক নিয়োগের অভিযোগ।
কম টাকায় ও অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া এসব শিশুকে দিয়ে বিরতিহীন ৮-১০ ঘণ্টার ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করানো হচ্ছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের কোথাও শিশুশ্রম থাকবে না। তবে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মোট ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ শিশুশ্রমিক রয়েছে। এদের মধ্যে ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯০ জন মেয়েশিশু, বাকিরা ছেলে। এরা উৎপাদন ও সেবার ১৮টি খাতে শ্রম দিচ্ছে।
এর মধ্যে উৎপাদন খাতে বা শিল্প-কারখানায় সাড়ে ৫ লাখ শিশু কাজ করছে। এ ছাড়া নির্মাণশিল্পে ১ লাখ ১৭ হাজার, দোকানপাটে ১ লাখ ৭৯ হাজার এবং ৫ লাখ সাত হাজার শিশু কৃষি খাতে কাজ করছে।
বর্তমানে দেশে কী পরিমাণ শিশু কাজ করছে, বয়স বিবেচনায় তাদের কত অংশের কাজ অনুমোদনযোগ্য এবং অনুমোদনহীন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কত- তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে।
বিবিএস সমীক্ষাটি পরিচালনা করে প্রতি চার বছর পরপর। নিয়ম অনুযায়ী, নতুন একটি সমীক্ষার তথ্য ২০২০ সালের মধ্যে প্রকাশের কথা থাকলেও করোনার কারণে তা হয়নি।
এসডিজির আরেকটি লক্ষ্য, কেউ পেছনে থাকবে না। অথচ বিবিএসের এই পরিসংখ্যানই ইঙ্গিত দিচ্ছে, এসব শিশুর পরিবারসহ জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দৃশ্যমানভাবে পিছিয়ে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, জাতিসংঘ ঘোষিত লক্ষ্য দুটি অর্জন করতে বাংলাদেশকে অবশ্যই শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন খাতে কাজ করা শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার জন্যও এটি জরুরি।
বিবিএস তথ্য অনুসারে, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৫ লাখ শিশুর শিশুশ্রম নির্মূল হয়েছে। তবে সরকারের এই প্রচেষ্টার পরেও নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয় আছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, পারিবারিক দারিদ্র্য, মালিকপক্ষের মানসিক দৈন্য ও বেশি মুনাফার আকাঙ্ক্ষা এবং সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতায় দেশ থেকে শিশুশ্রম পুরোপুরি নির্মূল করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে শ্রমের সঙ্গে জড়িত ১৭ লাখ শিশুর মধ্যে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও যুক্ত। কোনো একক খাত হিসেবে শুধু শিল্প-কারখানাতেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ।
শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের ১৮তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধনীতে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
সে অনুযায়ী ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু ঝুঁকিহীন কাজ করলেও সেটি শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে। আবার ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচিত হবে।
তবে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে তাদের শ্রম অনুমোদনযোগ্য। এভাবে কর্মরত শিশু, শিশুশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের আলাদা আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর শ্রীনিভাস বি রেড্ডি বলেন, ‘শিশুশ্রমের জন্য বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য একমাত্র কারণ নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক কারণ জড়িত। তবে দারিদ্র্য পরিস্থিতিও একটা বড় কারণ।
তিনি পরামর্শ দেন, যেসব পরিবারের শিশুরা কাজ না করলে সংসার চলবে না, তাদের কিছু ভাতার ব্যবস্থা করে ওই শিশুকে কাজে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে ওই শিশুর দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশে শিশুশ্রম নিয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সোবহান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিশুশ্রম নিরসনে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত। যার যার দায়িত্ব সে সে পালন করছে। এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। তবে আমরা চেষ্টা করছি সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার। একই সঙ্গে নজরদারি আরও বাড়ানোরও চেষ্টা করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে শ্রমসচিব বলেন, ‘ইতোমধ্যে আটটি খাতকে শিশুশ্রম মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, পাদুকাশিল্প, ট্যানারি, রেশম, সিরামিক, গ্লাস, জাহাজ প্রক্রিয়াজাতকরণ, চিংড়ি এবং রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প। বর্তমানে ৩৮টি খাতে শিশুদের শ্রম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া গৃহকর্মে শিশুশ্রম, শুঁটকিপল্লিতে শিশুশ্রম, পথশিশু, পাথর কুড়ানো-বহন-ভাঙানো, দর্জির কাজ শিশুশ্রম এবং ময়লার ভাগাড়ে শিশুশ্রম– এই ছয়টি খাতেও শিশুশ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার উদ্যোগ রয়েছে। এটি চলতি বছরেই ঘোষণা করা হবে।’
অন্যদিকে, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান মনে করছেন, বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকলেও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ শতভাগ সফল হবে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে আমাদের শিশুশ্রম নিরসন করতেই হবে। সরকার শিশুশ্রম বন্ধে নিরলস কাজ করছে। এই কাজের মধ্য দিয়ে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রম মুক্ত করার চেষ্টায় শতভাগ সাফল্য আসবে বলে সরকার আশা করছে।’
প্রতিমন্ত্রী জানান, শিশুশ্রম নিরুৎসাহিত করতে সরকার স্কুলগামী শিশুদের নগদ অর্থ, খাবারসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে। এ ছাড়া দরিদ্র্ পরিবার ও নিম্ন আয়ের লোকদের ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। আগামীতে এর পরিধি আরও বাড়বে। এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে।
তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তাই যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে, আগামী প্রজন্মের যাতে সুস্থ মনের বিকাশ ঘটে, সে জন্য শিশুশ্রম বন্ধে সবার মধ্যে মানবিক ও মমত্ববোধ জাগানোও দরকার।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে। এসডিজির টাইমলাইনের আলোকে যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন সে অনুযায়ীই এগোচ্ছিল সরকার। শিশুশ্রমের সংখ্যাও কমে আসছিল। তবে করোনা পরিস্থিতি সরকারকে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এই লক্ষ্য থেকেও বিচ্যুত করবে।’
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এই সময়ে দারিদ্র্য বেড়েছে। মানুষ বেকার হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। অপুষ্টির হার ও বাল্যবিবাহ সবটাই বেড়েছে। ফলে শিশুশ্রম সম্পর্কিত নতুন হিসাব না থাকলেও সার্বিকভাবে আগামীতে শিশুশ্রমের পরিধি বাড়বে এমন ধারণা করাই যায়।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় চারটি লক্ষ্য ধরে সরকারকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত, এসডিজির অ্যাকশন প্ল্যান ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী শিশুশ্রম নির্মূলে বাংলাদেশ সরকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। এর জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ব্যয়ের পরিধি বাড়াতে হবে।
‘তৃতীয়ত, রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিশুশ্রম নির্মূলে আগের মতোই সরকারের তৎপরতা বহাল রাখা, সেখানে ২০২৫ সালের মধ্যে সম্ভব না হোক- এসডিজির সবশেষ সীমা ২০৩০ সালের মধ্যেও যেন দেশকে শিশুশ্রম মুক্ত করা সম্ভব হয়। আর চতুর্থত, সব চেষ্টা সরকার করলেই হবে না, মালিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি।’
ড. গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘মালিক বা প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কোনোভাবেই ১৪ বছরের নিচের কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ না দেয়, সে বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকেই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকায় থাকতে হবে। একই সঙ্গে আগামীতে অনুমোদনযোগ্য ১৪-১৭ বছর বয়সের শিশুশ্রমও যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার না হতে পারে সে বিষয়েও আরও বেশি তৎপর এবং কঠোর হওয়া জরুরি।’