করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে শনাক্তের হার হু হু করে বেড়ে চলছে। এক সময় ঢাকাকেন্দ্রিক শনাক্তের পরিসংখ্যান বদলে গিয়ে ঢাকার বাইরে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর এখন ৫০ শতাংশের বেশি গ্রামগঞ্জে।
রোগীর ভিড় এখন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয়, যেখানে করোনা চিকিৎসার সুযোগ অনেক সীমিত। চিকিৎসকরা বলছেন, পরিস্থিতির আরেকটু অবনতি হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া কষ্টকর হয়ে যাবে।
কিন্তু এভাবে চিত্রটা উল্টে গেল কীভাবে? কেন রাজধানী ও বড় শহরগুলোর বাইরে করোনা ভয়াবহ রূপে ফিরে এলো?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর কয়েকটি কারণ অনুমান করছেন। তারা বলছেন, লকডাউনের মধ্যে ঢাকার মানুষের গ্রাম ফেরার প্রবণতা একটা কারণ হতে পারে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সীমান্তে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া। তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলে নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতাও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আগের চেয়ে বেশি লোক করোনা শনাক্তের পরীক্ষার আওতায় আসছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতাও গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ বৃদ্ধির একটা বড় কারণ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে আটটি বিভাগের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি খুলনা, ঢাকা ও রাজশাহীতে। গত এক সপ্তাহের করোনা পরীক্ষা ও শনাক্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ছিল শনাক্তের হার।
Covid Dhaka 7 DayInfogramকী বলছে পরিসংখ্যান
নিউজবাংলার পক্ষ থেকে ৪ জুলাই থেকে ১০ জুলাই এ সাত দিনের শনাক্তের হার ও পরীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময় ঢাকা বিভাগে শনাক্তের গড় হার ছিল ২৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
খুলনা বিভাগে শনাক্তের গড় ৩৫ দশমিক ১৫ শতাংশ।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের পর থেকেই সেটির হার সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল রাজশাহীতে। এ বিভাগে গত সাত দিনে শনাক্তের গড় হার ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
ঢাকার বাইরে করোনা শনাক্তের এই উচ্চ হার নিয়ে নিউজবাংলার সাথে কথা বলেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, লকডাউনের মধ্যে কর্মহীন মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে গেছে। সেখান থেকে করোনা পর্যায়ক্রমে গ্রামে ছড়িয়েছে। এটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সীমান্ত এলাকায় গ্রাম থেকে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে শনাক্ত বাড়ছে ।
তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘অনেক গ্রামের মধ্যে দিয়ে ভারতের সীমান্ত চলে গেছে। যখন প্রথম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ ধরা পড়ে, তখন এসব এলাকায় যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু লোকজন পায়ে হেঁটে চলাচল করেছে। এভাবে গ্রাম থেকে গ্রামে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এরই মধ্যে আবার ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য পরির্বতন হয়েছে উল্লেখ করে মোশতাক বলেন, ‘ভারতে যখন দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দিলো, তখন কুম্ভমেলায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। ভাইরাসটি খাপ খাইয়ে নিয়েছে শ্রমিক ও কৃষকের শরীরে। সেই ধরনটিই এখন বাংলাদেশে আসছে।’
কোরবানি ঈদে লোকে বিপুল পরিমাণে শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে। ঈদের পর লোকে গ্রাম থেকে ঢাকামুখী হলে আবার ঢাকায় সংক্রমণ বেশি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, বিশেষ করে শহর অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বেশি সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে।
খুলনায় শনাক্ত বেশি
এখন সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে খুলনায়। গত সাত দিনের রোগী শনাক্তের গড় হার ছিল ৩৫ শতাংশ।
হঠাৎ করে এত রোগী শনাক্তের কারণ জানতে চাইলে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সুহাস রঞ্জন হালদার নিউজবাংলাকে বলেন, আগের থেকে এখন পরীক্ষা বেশি হচ্ছে। মানুষ এখন করোনা উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা করাতে আসছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন করোনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছে।
বেশি মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই হাসপাতালে আসছেন শেষ মুহূর্তে। ততক্ষণে তাদের শারীরিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে। বেশির ভাগ রোগীর অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছে ৮০-এর নিচে। এ সমস্ত রোগীই মৃত্যুর তালিকা বাড়াচ্ছেন।’
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব রোগীর ডায়বেটিস, হার্টের সমস্যা রয়েছে, লিভারের রোগে আক্রান্ত ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত, অ্যাজমা, হাইপারটেনশন, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, করোনা আক্রান্ত হলেই তাদের অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা চেষ্টা চালিয়েও তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারছেন না। এ ছাড়া দেখা গেছে বেশি মারা যাচ্ছেন বয়স্ক রোগীরা।’
শনাক্তের হার কমে আসছে রাজশাহীতে
তিন বিভাগের মধ্যে শনাক্তের হার রাজশাহীতে কম। তবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট রাজশাহী সীমান্ত দিয়েই দেশে প্রবেশ করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শুরুতে এই বিভাগে শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এখন তা ২০-এর ঘরে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর কিছু দিন করোনা শনাক্তের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল। এখন অনেক কমে এসেছে। রাজশাহীতে গত বছর প্রথম ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি ৯৮ জন রোগী ভর্তি ছিল। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর সর্বোচ্চ ১৩৬ রোগী ভর্তি হয়েছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ অঞ্চলের একমাত্র ভরসার জায়গা উল্লেখ করে নওশাদ আলী বলেন, ‘এখানে নাটোর, নওগাঁসহ ছয়টি জেলার মানুষ চিকিৎসা সেবা নেয়। তার মানে ওই জেলাগুলোতেও রোগী কম ছিল। গত বছরের তুলনায় এবার রোগীর নমুনা পরীক্ষার বেড়েছে। পরবর্তীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে রোগী শনাক্তের হার কমতে শুরু করেছে।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার তুলনায় বাইরে এখন নমুনা পরীক্ষা বেশি হচ্ছে। সরকারের প্রচারণার কারণে মানুষ এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইউনিয়ন পর্যায়ে অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে, সেটা আগে ছিল না।’
করনীয় কী হতে পারে
আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন লকডাউনকেই সমাধান মনে করেন না। তিনি বলেন, এর সঙ্গে সঙ্গে যারা শনাক্ত হচ্ছে, তাদের প্রতিটি লোকের খোঁজখবর নিতে হবে। লোকজনের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে, অন্যদিকে বাড়িতে করোনা রোগীর সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যরা যাতে বসবাস না পারে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
তবে ঢাকায় দেশের অন্য জেলাগুলো থেকে শনাক্তের হার কম হচ্ছে। অনেকেই ভেবে নিয়েছেন, ঢাকারবাসীর দেহে অ্যান্টিবডি বেশি থাকার কারণে শনাক্ত কম।
এই ধারণাকে ভুল বলে জানান মুশতাক। তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে হলে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে। করোনা আক্রান্ত হয়ে যাদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাদের পরিমাণ অনেক কম। এ ছাড়া গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম– এটাও বাজে কথা। শহর ও গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র হওয়ার কারণে বিপদ ও মহামারি সম্পর্কে জানার পরও জীবিকার তাগিদে তারা লকডাউনের মধ্যে বাইরে বের হচ্ছে।