অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দেয়া সুপারিশ আমলে নিচ্ছে না বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ঘুষ-বাণিজ্য, নিয়োগে অনিয়ম, ক্রয়-বিক্রয়ে পুকুর চুরি, টেন্ডারবাজি ও জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম বন্ধে দুদকের দেয়া সুপারিশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েই হয়ে আছে ফাইলবন্দি।
সুপারিশ বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে হতাশ দুদক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দুদক কমিশনার বলেন, ‘সরকারি সেবাদানে বিদ্যমান দুর্নীতি, হয়রানি নিরসনে পদ্ধতিগত সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। দুদকের সুপারিশ বিচার-বিশ্লেষণ করে বাস্তবায়ন করা হলে জনগণ উপকৃত হবে। কিন্তু তা না করে, সুপারিশগুলো দীর্ঘদিন ফাইলবন্দি করে রাখা হয়েছে।’
এ বিষয়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দুদকের সুপারিশের আলোকে কাজ করে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন। তবে এর বাইরে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।
দুর্নীতি দমন কমিশন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধে ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর বা সংস্থাগুলোর দুর্নীতির বিভিন্ন উৎস চিহ্নিত করে। এরপর কার্যপ্রক্রিয়া ও পদ্ধতিগত সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ পাঠায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তা আমলে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বন্ধ হচ্ছে না প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি।
দুদকের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থ অপচয়ের দিকগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে ওই প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা, দুর্নীতির সম্ভাব্য উৎস ও তা প্রতিরোধের নিমিত্ত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশমালা প্রণয়ন করেন। অথচ তা ফাইলবন্দি থেকে যায় অবহেলায়।
দুদক গত কয়েক বছরে সরকারি সেবায় অনিয়ম-দুর্নীতি-দীর্ঘসূত্রতা রোধে খাতভিত্তিক বেশকিছু সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে ২৩টি খাত বা বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, ঢাকা ওয়াসা, গণপূর্ত অধিদপ্তর, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (ওসিজিএ), সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), কাস্টমস ও ভ্যাট, আয়কর বিভাগ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, ঢাকা মহানগরের সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, দেশের সব স্থলবন্দর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর ও অর্থ মন্ত্রণালয়।
দুদক ২০১৬ সাল থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আইনের বিধিবিধান অনুসরণ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অথবা এদের অধীন দপ্তর বা সংস্থাগুলোর কার্যপ্রক্রিয়া পদ্ধতিগত সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ দিয়ে আসছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলো তেমন কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। সুপারিশ বাস্তবায়ন করার তাগাদা দিয়ে দুদক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় দফা চিঠি দিলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এর মধ্যে হাসপাতালের যন্ত্রাংশ, ওষুধ, আসবাবপত্র ও আধুনিক প্রযুক্তি কেনায় দুর্নীতি-অনিয়মের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে তা বন্ধে ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বেশকিছু সুপারিশ পাঠিয়েছিল দুদক। এক বছরেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগাদা দিয়ে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেয় সংস্থাটি। কিন্তু এসব সুপারিশের অধিকাংশই কানে তোলেনি মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালেও স্বাস্থ্য খাতে দুদকের সুপারিশের ফলাফল শূন্য।
এদিকে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ নভেম্বর স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি রোধে দুদকের দেয়া ২৫ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
এর আগে গত বছরের জুনে মন্ত্রণালয় কেবল ১৪টি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে। সুপারিশ কার্যকর করা হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেয় দুদক।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুদক থেকে যেসব সুপারিশ দেয়া হয়েছে, আমরা প্রায় অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিয়েছি। অনেকগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। এবং যেখানে যেখানে আমরা দুর্নীতি দেখেছি সেখানেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। স্বাস্থ্য বিভাগে যারা অন্যায় করছে, আমাদের নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আগামীতেও আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
একই ঘটনা ঘটে বিমানের ক্ষেত্রেও। বিমানের দুর্নীতির বিভিন্ন উৎস ও তা প্রতিরোধে সুপারিশ করে ২০১৭ সালে চিঠি দেয় দুদক। এক বছরে তারাও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় ২০১৮ সালে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেয়া হয়। স্বাস্থ্য ও বিমানের মতো গণপূর্ত অধিদপ্তরে দুবার চিঠি গিয়েছে দুদক থেকে। দুর্নীতি বন্ধে এ সুপারিশ বাস্তবায়নে তারাও নির্বিকার।
এ বিষয়ে সদ্যবিদায়ী দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে মাঠপর্যায় থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি বিদ্যমান। দুদকের কর্মকর্তারা অনেক পরিশ্রম করে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা বন্ধে সুপারিশ করেছিলেন, অথচ সরকারি দপ্তরগুলো এসব সুপারিশকে গুরুত্ব দিচ্ছে না কিংবা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে আমরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত নিয়ে কাজ শুরু করি। কারণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এ দুই খাতের দুর্নীতি রোধ করা দরকার ছিল। অথচ তা সম্ভব হয়নি। দুদকের সুপারিশ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তার সঠিক চিত্র আমাদের কাছে নেই। হয়তো কিছু কিছু বাস্তবায়ন হচ্ছে, আবার কিছু কিছু হচ্ছে না।
‘পদ্ধতিগত দিক থেকে দুর্নীতির ফাঁক-ফোকরগুলো বন্ধ করা হলে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি অনেকাংশ কমে আসবে। জনগণ সরকারের সেবা নিতে এসে প্রতিদিন বিভিন্নভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, যা আমাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। অথচ সেবা পাওয়া জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের মানুষ যাতে সহজে সেবা পায়, সে জন্যই আমরা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধের সুপারিশ করেছি।’
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সুপারিশ প্রদান করে দুদক প্রশংসনীয় কাজ করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ছিল দুদকের সুপারিশগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নেয়া।
‘কিন্তু তা না করায় ব্যর্থতার দায়ে নিজেদেরই জবাবদিহি করা উচিত; তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরই জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। একই সঙ্গে দুদকের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে সরকারকেও সহায়তা করতে হবে। অর্থাৎ উভয় পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব হবে না।’