দুপুর ১টা ৫০ মিনিট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়। দুই শতাধিক লোক সামাজিক দূরত্ব মেনে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে রাস্তার উপরেই। অপেক্ষা খাবারের একটি প্যাকেটের।
শাটডাউনে কারণে কাজ হারিয়ে ফেলা খেটে খাওয়া ও ভাসমান মানুষদের শনিবার থেকে এই মোড়ে দুপুরের খাবার দিয়ে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত।
দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে ভ্যানগাড়ি করে খাবার নিয়ে হাজির হন সৈকত। হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করেন, ‘আমরা সবাই মাস্ক পরব এবং সামাজিক দূরুত্ব বজায় রাখব। যাদের মুখে মাস্ক থাকবে না তারা মাস্ক নিয়ে তারপর লাইনে বসুন।’
এরপর শুরু খাবার বিতরণ। বিতরণ শেষে সৈকত হ্যান্ড মাইকে জানতে চাইলেন, খাবার পায়নি এ রকম কেউ আছে কিনা। দেখা যায়, ২৩ জন খাবার পাননি। তাৎক্ষণিক ভাত রান্না করে তাদেরও খাবার দিলেন সৈকত।
তানভীর হাসান সৈকত শনিবার থেকে শুধু দুপুরের খাবার দিয়ে আসলেও গত বুধবার থেকে তিনি রাতের খাবারও দিচ্ছেন। নিজের অর্থায়নসহ বন্ধু-বান্ধব ও বড় ভাইদের সহযোগিতায় তিনি খরচ চালাচ্ছেন।
টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফটকের সামনে রান্না করে প্রতিদিন দুবেলা পাঁচ শতাধিক মানুষের খাবারের জোগান দেয়া হচ্ছে।
খাবার বিতরণে সৈকতকে সাহায্য করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের নাহিদ, মার্কেটিংয়ের মাঈদুল, স্বাস্থ্য অর্থনীতির মেহেদী ও সঙ্গীত বিভাগের সুজন।
করোনা সংক্রমণের শুরুতে দেশে লকডাউন শুরু হলে গত বছরের ২৫ মার্চ থেকে টানা ১২১ দিন টিএসসি এলাকায় অসহায়-ভাসমান মানুষের মাঝে খাবার বিলিয়েছেন সৈকত। প্রথমদিকে নিজের পকেটের ১৩ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলেও পরে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সহায়তা পেয়ে দৈনিক ১ হাজার মানুষের খাবার জুগিয়েছেন তিনি। এমন মানবিক কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। জাতিসংঘ থেকে দেওয়া হয়েছে ‘রিয়েল লাইফ হিরোর’ মর্যদা।
খেতে আসা এক লোক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ছোট ব্যবসা করি। লকডাউনে দোকান বন্ধ এক সপ্তাহ। আত্মসম্মানের জন্য জীবনে কারো কাছে হাত পাতিনি। এখন এমন পরিস্থিতি, তিন চারদিন বসে খেলে পয়সা আর থাকে না। সৈকত ভাই খাবার দিচ্ছে শুনে আসলাম। এখন অর্ধাহারে অনাহারে থেকে যতটুকু পারা যায় তাতেই শুকরিয়া।’
মশিউল মোল্লা নামের আরেকজন বলেন, ‘আমি আগে প্রাইভেট কার চালাইতাম, এখন অসুস্থ। তাই বাধ্য হয়ে এখানে আসলাম। সৈকত ভাইয়ের মতো বাংলাদেশের সবাইকে গরীব দুঃখি মানুষের পাশে আসা উচিত।’
রিকশাচালক সেলিম মিয়া বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই। আগের মতো এখন আর ভাড়া নাই। কাজ নাই বলেই এখানে খেতে আসছি।’
তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘লকডাউনের কারণে যাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, সেসব শ্রমজীবী এবং ভবঘুরে মানুষদের আমরা দুবেলা খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। ব্যক্তি উদ্যোগে এটা শুরু করলেও অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সাহায্য করেছেন।'
কেন এ উদ্যোগ, জানতে চাইলে সৈকত বলেন, ‘যে মানুষগুলোর ভ্যাট ও ট্যাক্সের টাকায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, তাদের জন্য আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। সেই দায় থেকেই আমরা কিছু করার চেষ্টা করছি। আর আমরা যদি এ মানুষগুলোর পাশে না দাঁড়াই, তা হলে এরা যাবে কই? এরা তো কোটি টাকা পাচার করে না। এরাই দেশের প্রকৃত মানুষ।’
লক্ষ্মীপুর থেকে আসা সৈকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স বিভাগের মাস্টার্সে পড়ছেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক।