বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তাঁতী লীগে তাঁতী নেই, আছে কমিটি-বাণিজ্য

  •    
  • ৬ জুলাই, ২০২১ ২৩:০৮

বাংলাদেশ তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ১০১ সদস্যের মধ্যে কোনো তাঁতী খুঁজে পাওয়া যায়নি। কমিটিতে রয়েছেন প্রকৌশলী, অধ্যাপক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে নানান অনিয়মের অভিযোগ প্রায়ই ওঠে।

বাংলাদেশ তাঁতী লীগের ঘোষিত লক্ষ্য দেশের তাঁতীসমাজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাঁতীদের নিয়ে কোনো কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি সংগঠনটি। বরং অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসছেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা। কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে দুই বছর আগে।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনটির মূল লক্ষ্য তিনটি: তাঁতীসমাজসহ পশ্চাৎপদ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাঁতশিল্প ও বস্ত্র খাতের সংকট চিহ্নিত করে বাস্তবমুখী সমাধানের কর্মসূচি গ্রহণ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে দলের সব কর্মসূচি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করা।

পাকিস্তান তাঁতী সমিতি নাম নিয়ে ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংগঠন। স্বাধীনতার পর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ তাঁতী সমিতি। ২০০৪ সালে তাঁতী লীগ নাম নিয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু সংগঠনটির। তাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালেই শেষ হয়েছে কমিটির মেয়াদ। সারা দেশের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলায় রয়েছে তাঁতী লীগের কার্যক্রম।

তাঁতীদের সংগঠন হিসেবে এতে তাঁতীদেরই প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির ১০১ সদস্যের মধ্যে কোনো তাঁতী খুঁজে পাওয়া যায়নি। কমিটিতে রয়েছেন প্রকৌশলী, অধ্যাপক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।

সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁতীদের উন্নয়নে কোনো কর্মসূচি নেই তাদের। বরং ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন হিসেবে নানা সুবিধা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিলেও তাঁতী লীগের এ রকম কোনো কর্মসূচির কথা শোনা যায়নি।

কমিটির বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ

তাঁতীদের নিয়ে কোনো কার্যক্রম না থাকলেও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কমিটি-বাণিজ্যসহ অর্থ আদায়ের নানা অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে অনেককেই কমিটিতে স্থান দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

তাঁতী লীগের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলী পেশায় ব্যবসায়ী। নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় নানা ব্যবসা রয়েছে তার। শওকত আলীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখলের অভিযোগে আওয়ামী লীগ উচ্চপর্যায়ে বেশ কয়েকবার অভিযোগ দিয়েছেন সংগঠনের বেশ কয়েকজন কর্মী।

সাধারণ সম্পাদক খগেন চন্দ্র দেবনাথের বিরুদ্ধে শাখা কমিটি অনুমোদনের বিনিময়ে নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, তিনি একই সঙ্গে ভারতের দ্বৈত নাগরিক। দেশ থেকে অর্থ পাচার করে ভারতে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের কাছে দেয়া এমন বেশ কিছু লিখিত অভিযোগের কপি সংগ্রহ করেছে নিউজবাংলা।

২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বরগুনা জেলা তাঁতী লীগের সভাপতি ইদ্রিস চৌধুরী ও সাধারণ সম্পদক সাগর কর্মকার সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কাছে একটি চিঠি লেখেন।

এতে তাঁতী লীগের সহসভাপতি জাহাঙ্গীর বিশ্বাস জেলা কমিটি না ভেঙে দেয়ার জন্য ইদ্রিস চৌধুরী ও সাগর কর্মকারের কাছে ২ লাখ করে মোট ৪ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বলে অভিযোগ করা হয়।

একই রকম একটি অভিযোগ করেন ঠাকুরগাঁও জেলা তাঁতী লীগের সাবেক আহ্বায়ক রবিউল ইসলাম রবি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো এক অভিযোগপত্রে তিনি দাবি করেন, প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক হওয়ার পরেও ৫ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় তাকে পরবর্তী সময়ে কমিটিতে স্থান দেয়া হয়নি।

এ ছাড়া সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দুর্নীতি দমন কমিশনেও আবেদন করেছেন। এসব আবেদনের কপিও সংগ্রহ করেছে নিউজবাংলা।

তবে অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁতী লীগের নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

কী বলছেন সংগঠনের নেতারা

তাঁতীদের সংগঠন অথচ তাঁতীদের নিয়ে কোনো কর্মসূচি কেন নেই, তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা।

সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খান নুর এ খোদা মঞ্জু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু এটা পেশাজীবী সংগঠন, তাঁতীদের সংগঠন, এখানে যেমন তাঁতীদের কাজ হবে, একইভাবে নেত্রীর আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমরা কাজ করব, এমনটাই হওয়ার কথা। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল আওয়ামী লীগের আদর্শকে তাঁতীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। আর আমরা দলীয় সরকারের মাধ্যমে তাঁতীদের একটা স্মার্ট গ্রুপ তৈরি করব।

‘তারা যে বস্ত্র তৈরি করে, বিশ্বে এটার পার্মানেন্ট বাজার তৈরি করব। কিন্তু এটা নেতৃত্বের বিষয়। যারা এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আমিও আছি, কিন্তু আমি দ্বিতীয় লাইনের। এটা হয়তো সভাপতি-সেক্রেটারি তাঁতীদের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। এ কারণেই তাঁতীদের নিয়ে কোনো প্রোগ্রাম এখনো হয়নি।’

সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের নামেই অনৈতিক অর্থ আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘যখন ১০১ সদস্যর কমিটি হলো, তখন তো কিছু দুর্বৃত্ত সেখানে ঢুকেছিল। ফ্রিডম পার্টি, জামায়াত-বিএনপি থেকে ঢুকেছে, এটা দেখা যায়। তিনজনকে বহিষ্কারও করা হয়েছে, তারা নেত্রীর ফাঁসি দাবি করেছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে, বহিষ্কার করা হয়েছে।

‘এরপরেও কয়েকজনের বিষয়ে শোনা যায়। কিন্তু এটা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বলতে পারবেন। খগেন বাবুর (সাধারণ সম্পাদক) বিষয়েও বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায়। দু-একজন অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আমি তো এটা দেখিনি। এটা আপনারা বের করেন। আমি শুনেছি।’

তাঁতী লীগের কাজ আসলে কী, টেলিফোনে জানতে চাইলে সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলী নিউজবাংলাকে জানান, তাঁতীদের নিয়ে তাদের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। তবে কোনো কর্মসূচির নামই বলতে পারেননি তিনি।

তিনি বলেন, ‘তাঁতীদের নিয়ে অনেক প্রোগ্রাম করছি, এগুলো এভাবে তো বলতে পারব না। সাক্ষাতে বলব। এগুলো বিক্ষিপ্তভাবে বলা ঠিক হবে না। কারণ আমি তো একটা অবস্থানে আছি, আমার কথাটা ভুল হয়ে গেলে সমস্যা।’

তাঁতী নেই- এমন অনেক স্থানেই সংগঠনের কমিটি রয়েছে, এর কারণ জানতে চাইলে তাঁতী লীগের সভাপতি বলেন, ‘তাঁতী আছে সারা বাংলাদেশের কিছু এলাকায়। আমরা মূলত প্রতিটি জেলায়, থানায়, ইউনিয়নে (কমিটি) করছি। আমাদের এই নামে একটা সংগঠন দাঁড়ালে এটার মধ্যে লাখ লাখ কর্মী পাব।

‘সংগঠনকে গোছানোর মাধ্যমে দলের মধ্যে যেন জনপ্রিয়তা বাড়ে, লোক বেশি হয়, এ জন্য একটা সংগঠন, আমরা যে জেলায় তাঁতী নেই, সেই জেলাতেও কমিটি করি। কেন করি? সংগঠনটা হলে এটা তো আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন, যদি লোক আসে, তাহলে দলের প্রোগ্রামে লোক আসে। এ জন্য আমরা ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যন্ত করছি।’

কমিটি-বাণিজ্য কিংবা অর্থ লেনদেনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খগেন চন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর গত ১৭ জুন তিনি জানান, তিনি একটি সভায় ব্যস্ত আছেন। পরে কথা বলবেন।

এরপর টানা কয়েক দিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি আর কথা বলেননি।

অপকর্মের দায় আওয়ামী লীগ নেবে না

কোনো সহযোগী সংগঠন বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী অপকর্ম করলে তার দায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেবে না বলে জানিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।

তাঁতী লীগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, আমাদের সামনে তা উপস্থাপন করলে আমরা অবশ্যই কঠোরভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এদের আমরা দল থেকে বের করে দেব। কারণ দলের বদনাম করার কোনো সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মানুষের কল্যাণে কাজ করে। দু-একজন যদি কোথাও কোনো অপকর্ম করে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন।’

এ বিভাগের আরো খবর