সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষায় ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনার তীরে নির্মাণ করা হয়েছিল শতবর্ষ স্থায়িত্বের বাঁধ। ১৯৯৭ সালের বাঁধটিতে শতবর্ষ দূরে থাক, মাত্র ১২ বছর পরই ভাঙন দেখা দেয়।
এরপর ১২ বছরে পাঁচবার ভাঙন সংস্কারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। তারপরও থামেনি ভাঙন। সবশেষ গত মঙ্গলবার দুপুরে বাঁধের পুরোনো জেলখানা ঘাট এলাকায় ধস শুরু হয়।
বর্ষা এলেই আতঙ্কে থাকা জেলাবাসীর অভিযোগ, বাঁধ মেরামতে বরাদ্দের সিংহভাগই লুটপাট হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং তদারকিও নেই। এ কারণে বারবার ভাঙন দেখা দিচ্ছে।
অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দাবি, কোনো টাকাই লুটপাট হয়নি, বরং জেলাকে নদীভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছে এসব প্রকল্প।
আড়াই কিলোমিটারের শহর রক্ষা বাঁধটির নির্মাতা ছিল দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হুন্দাই লিমিটেড। নির্মাণের পর প্রতিষ্ঠানটি এর স্থায়িত্ব নির্ধারণ করে ১০০ বছর। তবে এর জন্য কিছু নির্দেশনা দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
তার মধ্যে ছিল হাইড্রোগ্রাফি (নদীর তলদেশ) সার্ভেয়ার দিয়ে প্রতিনিয়ত অবস্থা পর্যবেক্ষণ। জরুরি মেরামতের জন্য বাঁধের ওপর ১ হাজার ৪০০ ঘনমিটার হার্ডরক ও ৩০ হাজার সিসি ব্লক মজুত রাখা।
সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধে মঙ্গলবার পঞ্চমবারের মতো ধস শুরু হয়
হস্তান্তরের পর বাঁধটি দেখাশোনার জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্রহ্মপুত্র রাইট এনব্যাংকমেন্ট (বিআরই) বা ব্রহ্মপুত্র ডান তীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নামে সিরাজগঞ্জে একটি শাখা স্থাপন করে।
বিআরই হার্ডপয়েন্টের আড়াই কিলোমিটারসহ উত্তর-দক্ষিণে আরও এক কিলোমিটার ক্রসবার (নদীশাসনে নির্মিত বাঁধ) দেখাশোনা করত। হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ার দিয়ে তদারকিও করত।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটি জানায়, ২০১৭ সালে কোনো কারণ না দেখিয়ে এই বিআরই শাখা সিরাজগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ চলে যায়। ২০১৯ সালে বাঁধের জরুরি কাজের জন্য রাখা ১ হাজার ৪০০ ঘনমিটার হার্ডরক ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ক্রসবার বাঁধে। বর্তমানে বাঁধের ওপরে একটি হার্ডরকও নেই।
কমিটির অভিযোগ, এখানে কখনও স্থায়ীভাবে কোনো হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ার ছিলেন না। যিনি এ কাজ করেন তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। হুন্দাই কোম্পানির সার্ভেয়ারের স্পিডবোটচালককে দিয়ে এ কাজ করানো হয়।
স্থানীয় একডালা এলাকার আবু জাফর অভিযোগ করেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঠিক তদারকি না থাকায় বারবার ভাঙনের কবলে পড়ছে বাঁধটি। বিআরই শাখা চলে যাওয়ার পর পাউবোর কর্মকর্তারা বাঁধের ওপর গাছ রোপণ আর বিভিন্ন চাকচিক্য করা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। বাঁধের নিচে কখনোই কোনো কাজ করেন না। বাঁধে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বরাদ্দও হয় হরিলুট।
বাঁধটি রক্ষা করতে হলে বিআরইয়ের মতো বিশেষ শাখাকে দায়িত্ব দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটি যুগ্ম আহ্বায়ক নব কুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ মেরামত আর বর্ষার শুরু থেকেই প্রতিনিয়ত তদারকি করলে বাঁধ ধসার আশঙ্কা কম থাকলেও পাউবো কখনোই তা করে না। যে কারণে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
‘বিশেষ করে এই বাঁধটি দেখভালের জন্য যে বিআরই শাখা ছিল, তা সুপরিকল্পিতভাবে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাঁধের ওপর যে হার্ডরকগুলো ছিল, সেগুলো বিভিন্ন ক্রসবার প্রকল্পে কাজে লাগিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘১২ বছরে ১৮০ কোটি টাকার সিংহভাগ লুটপাট করেছেন পাউবোর কর্মকর্তা আর ঠিকাদাররা। তারা সব সময় এই অর্থ বরাদ্দ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কখনোই বাঁধ মেরামত নিয়ে ব্যস্ততা দেখিনি। যখন ভেঙে যায়, তখন জরুরি মেরামতের নামে চলে সার্কাস।’
বাঁধ পর্যবেক্ষণে স্থায়ী হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ার নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণের সময় হুন্দাই কোম্পানির জাপানি হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ার একজনের স্পিডবোটে উঠে বাঁধ সার্ভে করতেন। সেই চালক তার কাছ থেকে কিছু কাজ শিখেছেন।
‘হুন্দাই কোম্পানি যাওয়ার পর পাউবো ওই স্পিডবোটচালককে হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। অ্যাকাডেমিক শিক্ষা না থাকা সেই ব্যক্তিই ইন্দ্রশক্তি দিয়ে সার্ভে করছেন।’
স্পিডবোটচালক ও সহকারী হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ার আব্দুর রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে কোনো শিক্ষা না থাকলেও আমি জাপানি সার্ভেয়ারের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। তিনি আমাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।
‘আমাকে এখনও স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়নি। অস্থায়ীভাবে মাঝে মাঝে আমাকে দিয়ে হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ারের কাজ করানো হয়।’
তিনি সঠিকভাবেই কাজ করতে পারেন দাবি করে বলেন, ‘আষাঢ়ের শুরুতেই আমি পাউবোর স্যারদের বলেছি এখন ভাঙন শুরু হওয়ার জায়গার ঠিক পূর্ব দিকে বড় গর্ত হয়েছে। দ্রুত কাজ করতে হবে।
‘কিন্তু এই গর্তটি বাঁধের নির্ধারিত স্থান থেকে অনেক দূরে হওয়ার কারণে স্যারেরা কাজ করতে পারেননি। তাই পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই গর্তের সোজা পানি টান দিলে বাঁধ ভেঙে যায়।’
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাঁধের পূর্ব দিকে চরের কারণে এবার পশ্চিমে স্রোত বেশি। নদীর ঘূর্ণাবর্তের কারণে তীর ভাঙছে। আর যেন না ভাঙে, সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
‘গর্তের বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। এটি একটি আকস্মিক ভাঙন। আর বিআরই শাখা থাকা অবস্থায় কী হয়েছে, তা আমি বলতে পারব না।’
হার্ডরকগুলোর বিষয়ে তিনি দাবি করেন, জরুরি সময়ে হার্ডরক ফেলা অনেক কঠিন। অন্যদিকে ৩ নম্বর ক্রসবারে হার্ডরক জরুরি ছিল বলে সেখানে কাজে লাগানো হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম শফিকুল হক বলেন, ‘বরাদ্দ করা একটি পয়সাও লুটপাট হয়নি, বরং জেলাকে নদীভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছে এসব প্রকল্প। বর্তমানে শহর রক্ষা বাঁধ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।’
স্থায়ী হাইড্রোগ্রাফি সার্ভেয়ার নিয়োগ দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে কথা বলবেন বলে জানান পাউবোর এই কর্মকর্তা।