বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তালেবান শাসন চলা এলাকায় ৫ দিন

  •    
  • ২৬ জুন, ২০২১ ১৬:৪৩

সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইস-এর সংবাদকর্মীদের একটি দল সম্প্রতি আফগানিস্তানের তালেবাননিয়ন্ত্রিত ওয়ারদাক রাজ্যে পাঁচ দিন কাটিয়েছে। তাদের এই সফরের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে অ্যাডাম ডেসিডারিওর প্রতিবেদনে।

আফগানিস্তানে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর হামলার পর পতন হয় তালেবান সরকারের। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর কাবুল থেকে পিছু হটে তালেবান বাহিনী। তবে এর পরের ২০ বছরেও দেশটি থেকে উৎখাত করা যায়নি কট্টোর এই গোষ্ঠীকে। বরং সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর ফের নতুন অঞ্চলের দখল নিচ্ছে তালেবানরা।

আফগানিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। দেশটির ৪০৭টি ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে ৭০টিতে চলছে এই গোষ্ঠীর শাসন।

সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইস-এর সংবাদকর্মীদের একটি দল সম্প্রতি আফগানিস্তানের তালেবাননিয়ন্ত্রিত ওয়ারদাক রাজ্যে পাঁচ দিন কাটিয়েছে। তাদের এই সফরের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে অ্যাডাম ডেসিডারিওর প্রতিবেদনে। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।

ঘড়িতে ভোর ৫টার একটু বেশি। কোনো এক শুক্রবার এক পুরোনো টয়োটা করোলার পেছনের সিটে চেপে, লুকিয়ে আমরা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি। গাড়ির সামনে বসা স্থানীয় গাইড আমাদের তিনজনের দলটিকে ঘাড় ঘুরিয়ে পরখ করে নেন যে, তালেবাননিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে দুই দিনের ভ্রমণের জন্য আমাদের পোশাক ঠিক আছে কি না।

আমাদের গাড়িচালক স্থূল রসবোধসম্পন্ন, সাদা দাড়ির, বেঁটে ও গাট্টাগোট্টা শরীরের এক আফগান। রিয়ার ভিউ মিররে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি জোরে বলে ওঠেন, ‘কান্দাহার’।

আমার পরনে ছিল একটা রোদে জ্বলে যাওয়া সালোয়ার-কামিজ, একটা সবুজ রঙের শাল আর তার সঙ্গে ম্যাচ করা টুপি, যাকে এখানে বলা হয় সিন্ধি। আর আমাদের দলের একমাত্র নারী সদস্য ভাইসের নিউজ করেসপনডেন্ট হিন্দ হাসানের পরনে ছিল তালেবানরা ঘরের বাইরে বের হওয়ার সময় নারীদের যেমন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে বলে, তেমনভাবে ঢাকা নীল রঙের আফগানি বোরকা।

আমাদের গন্তব্য ওয়ারদাক রাজ্য। এটি মধ্য আফগানিস্তানের একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, কারণ এটাই রাজধানী কাবুলে ঢোকার রাস্তা। ওয়ারদাকে যাওয়ার জন্য আমরা যুদ্ধবিধ্বস্ত ন্যাশনাল হাইওয়ে ওয়ান ধরে এগোচ্ছিলাম। কাবুলকে এটি তালেবানের জন্মস্থান কান্দাহারের সঙ্গে যুক্ত করে।

আমাদের সামনেই ধীরেসুস্থে এগোতে থাকা আফগান ন্যাশনাল আর্মির (এএনএ) বেশ কিছু হামভি জিপ। কাছের কোনো পোস্টে সাপ্লাই নিয়ে যাচ্ছিল ওগুলো। পরের এক ঘণ্টায় আমরা যুদ্ধ করছে না, কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে আটকে যাওয়া আফগান বেসামরিক নাগরিকদের জীবন কেমন হয়, সেটার ভয়াবহ কিছু ঝলক দেখতে পেলাম।

জানতে পারলাম, তালেবানরা এএনএকে আক্রমণের চেষ্টা করছে। সৈন্যরা আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাস্তার বাস ও আমাদের মতো গাড়ির লম্বা সারির মধ্যে লুকিয়ে থাকে।

এই কৌশল সরাসরি তালেবানদের কাছ থেকেই ওদের শেখা। আমরা এগোতে শুরু করার পরই সৈন্যরা সবুজ ঝোপের দিকে রাইফেল তাক করে গুলি করতে শুরু করে। এ ধরনের ঝোপ তালেবানরা লুকানোর জন্য ব্যবহার করে।

তালেবানদের দেশে

আমাদের স্থানীয় গাইড জানালেন, ‘এই চেক পয়েন্টের পর থেকে সবকিছুই তালেবানদের অধীনে।’

এখান থেকে মোটরসাইকেলে চড়া একদল তালেবান যোদ্ধা আমাদের পথ দেখাবেন। কাবুলে তারা আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি দেয়নি। আর যেকোনো ধরনের ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহারে ছিল কড়া নিষেধ।

মূল সড়ক থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ওপর ছোট একটা গ্রাম আরব শাহ খেল। ওখানকার প্রায় পূর্ণ আর বিস্তৃত কবরস্থান খুব ভালোভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের প্রকৃত মূল্য। ২০০১ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে এই যুদ্ধে ৭১ হাজার আফগান নাগরিক নিহত হয়েছেন।

নিজের বোন নাসিবাহর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ২৫ বছরের আমরুল্লাহ ক্বানি বলেন, ‘এখানে প্রতিদিনই যুদ্ধ হয়। যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন বাড়িতে গুলি এসে পড়ে আর বিস্ফোরণ হয়।’

নিজ বাড়িতে মর্টারের আঘাতে নিহত হন নাসিবাহ। আমিরুল্লাহ বলেন, ‘আমার বোন খুবই হৃদয়বান ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক যে এমনটা ওর সঙ্গে হয়েছে।’

কাছেরই আরেকটি গ্রাম মালি খেলের ২৮ বছরের বাসিন্দা সাফিউল্লাহ অশ্রুভরা চোখে স্থানীয় এক মসজিদ ধ্বংসের কথা আমাদের বলেন।

‘তারা (আমেরিকানরা) আমাদের কোরআনকে অপমান করেছে। মসজিদকে অপমান করেছে। এটা আমাদের কাছে মক্কার মতো ছিল।’

মসজিদের তৃতীয় তলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। ধর্মীয় নেতারা শিশুদের ধ্বংসস্তূপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোরআন ও অন্যান্য ধর্মীয় বইয়ের টুকরাগুলো জড়ো করতে বিভিন্নভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন।

গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের একজন নেমাতুল্লাহ বলেন, ‘আমি সব মাফ করে দিতে পারব, কিন্তু এটা না। এখানেই আমার হৃদয় পড়ে আছে, আর এটাতেই আমি বিশ্বাস করি। এখানে কোনো তালেবান দেখছেন? আল-কায়েদা? নেই!’

গ্রামবাসী দিয়ে ঘিরে থাকা অবস্থায় সাফিউল্লাহ জানান, মাঝরাতে মাথার ওপরে ড্রোনের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। এর একটু পরই মসজিদে আঘাত হানা হয়। ‘এটা শান্তি নয়’, বোমা বিস্ফোরণের জায়গা থেকে পাওয়া একটা শার্পনেলের টুকরা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা সন্ত্রাস।’

আমরা আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বোমার অংশবিশেষের ছবি দেখাই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ধাতব খণ্ডটি জিবিইউ টুয়েলভ মডেলের লেজার গাইডেড বোমার ডানার অংশ। এমকে এইটি টু নামেও পরিচিত বোমাটি আফগান ও আমেরিকান দুই দেশের যুদ্ধবিমানই ব্যবহার করে। এতে আঁকা চিহ্ন দেখে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রেথিওন গত বছরের মার্চে বোমাটি বানিয়েছে। বানানো হয়েছে দোহায় তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিচুক্তির এক মাস পর।

ভাইস নিউজকে দেয়া এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মালি খেলে আক্রমণের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে বারবার অনুরোধের পরেও আফগান সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

সম্প্রতি সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তালেবানের সিভিল ক্যাজুয়াল্টিস প্রিভেনশন অ্যান্ড কমপ্লেইন্টস কমিশনের প্রতিনিধি কমান্ডার খাদেম বলেন, “এগুলো সবই কাবুলের ‘পুতুল সরকার’-এর কাজ। কাবুল সরকার এলাকায় তালেবানের উপস্থিতি আছে কি না, তা না জেনেই আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।’

খাদেম রাতের বেলা আমাদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখছিলেন। একটি বৈরী এলাকায় আমরা পাশ্চাত্য সাংবাদিক, আর তাই তালেবানের অন্য উগ্রবাদী সদস্যদের কাছে থেকে আমাদের দূরে রাখার নির্দেশনা ছিল তার ওপর।

আমরা এক এপিক যাত্রা শুরু করি। নদীর ওপর দিয়ে, পাহাড়ের কিনারা ধরে কর্দমাক্ত চার ঘণ্টার এক যাত্রা শেষে দুর্গম এক পাহাড়ের সেফহাউসে পৌঁছাই, যেখানে আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।

পরদিন সকালে বান্দ-ই-চাক জেলার সামরিক প্রধান কমান্ডার খাতাবের সঙ্গে দেখা হয়। কালো কাপড় পরা ও কালাশনিকভ হাতে চার যোদ্ধাকে পাশে নিয়ে থাকা খাতাব আমাদের উপস্থিতিতে বিরক্ত হচ্ছিলেন, আর সাক্ষাৎকারের বেশির ভাগ সময়ে চুপ করে ছিলেন।

জেলার এক সামরিক উপ-প্রধান নাউয়িদ বলেন, ‘আমরা আমেরিকান গণতন্ত্র চাই না। আমেরিকা এখানে গণতন্ত্রের যে নীতি প্রয়োগ করেছে এবং জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তা কেবল আফগানিস্তানের জনগণের ক্ষতিই করবে, আর কিছু নয়।’

আমেরিকান সেনারা এক মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়তে যাচ্ছে। অনেক আফগানের আশঙ্কা, তালেবান তার পুরোনো পথে ফিরে আসবে, ইসলামি শরিয়াহ আইনের উগ্র ব্যাখ্যায় নারীর অধিকার সীমাবদ্ধ করবে ও সমাজকে পরিচালনা করবে। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে কমান্ডার খাতাব দ্রুত প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।

‘শুটিং বন্ধ করুন। বন্ধ করুন,’ হাসতে হাসতে বলে ওঠেন খাতাব। মাঝপথে সাক্ষাৎকার বন্ধ করে দেন এবং আমাদের ক্যামেরা বন্ধ করে কাবুল ফিরে যেতে বলেন।

তালেবানের অধীনে জীবন

ছয় মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেকের প্রাক্কালে তালেবানদের সঙ্গে তিন দিন কাটানোর জন্য আমাদের আবার ওয়ারদাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

এবার পরিষ্কার ছিল যে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জোর করে ক্ষমতা ফিরে পেতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী দেশজুড়ে বিস্তৃত অঞ্চল দখলের অভিযান আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ধারণা অনুযায়ী, গোষ্ঠীটি দেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি অংশে নিয়ন্ত্রণ করছে বা দখলের চেষ্টা করছে। ৭০টিরও বেশি জেলা তাদের কবজায়। প্রতি সপ্তাহে এই সংখ্যা বাড়ছে।

তালেবান যোদ্ধা ও বোমা কারিগর মজিবুল রাহমান বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে যত কনভয় আসুক না কেন, আমরা তাদের জন্য আইইডি পেতে রাখি।’ সোডার বোতলে বোমা ভরে আফগান সৈনিকদের হত্যা করে গর্বিত মজিবুল যোগ করেন, ‘আমি তাদের টুকররা করে উড়িয়ে দিয়েছি। একেবারে আকাশে উড়িয়েছি।’

তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনার অচলাবস্থায় এবং আমেরিকান বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রগুলোকে দ্রুত ছেড়ে দিতে থাকায় তালেবানরা তাদের পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার একেবারে কাছাকাছি আছে। যে ব্যবস্থা আমেরিকান নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের মাধ্যমে ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে তাদের হটে যাওয়ার আগে ছিল।

‘আফগানিস্তান তাদের (আমেরিকানদের) তৈরি ব্যবস্থায় চলে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়’, বলছিলেন ২০ জন যোদ্ধা দিয়ে ঘিরে থাকা কমান্ডার হামাস। পাহাড়ের ওপর থেকে টাঙ্গি উপত্যকার দিকে তাকিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যখন তারা আমাদের বলবে, দেশে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হচ্ছে, তখনই আমরা অস্ত্র জমা দিয়ে ইসলামিক শাসনব্যবস্থার অংশ হতে প্রস্তুত।’

তালেবানদের দাবি, তারা আগের মতো নারীদের অধিকার বঞ্চিত করা, মেয়েদের স্কুলে যেতে বাধা দেয়া, চোরদের হাত কেটে শাস্তি দেয়া, প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা ও ব্যভিচারের দায়ে নারীদের পাথর ছুড়ে হত্যা করার মতো নৃশংস গোষ্ঠী আর নেই।

কমান্ডার হামাসের দাবি, ‘সত্যি কথা হচ্ছে, আফগানিস্তানে বসবাসকারী মুসলিম পুরুষ ও নারীর ইসলামিক ব্যবস্থাকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই, কারণ ইসলামিক শাসনব্যবস্থা শান্তি, একতা ও উন্নয়ন নিয়ে আসে। ইনশাল্লাহ সবার অধিকারই রক্ষা করা হবে এবং সবাই নিরাপদে থাকবেন।’

আমাদের তালেবান গাইড দেখাতে উদগ্রীব ছিলেন যে তারা কতটা বদলে গেছেন। তারা গ্রামের একটা বাজারে আমাদের নিয়ে যান যেখানে তরুণ যুবকরা প্রকাশ্যে ধূমপান করছিল, ভলিবল খেলছিল। এসব কর্মকাণ্ড আগে তালেবানরা নিষিদ্ধ করেছিল, কিন্তু এখন কিছু কিছু এলাকায় তারা এসবের অনুমতি দিয়েছে।

এটাই হয়তো তারা আমাদের দেখাতে চেয়েছিল। তবে এটি স্পষ্ট যে, প্রাত্যহিক জীবনের অনেক দিকেই কোনো বদল আসেনি। বাইরে খুব বেশি নারীর দেখা মেলে না; টেলিভিশন দেখা, গান শোনা ও খেলাধুলা করা এখনও নিষিদ্ধ; আর এই সামাজিক নিয়মকানুন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কঠোরভাবে কার্যকর রাখে সশস্ত্র যোদ্ধারা, যারা ভয়, সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শনের ওপর নির্ভর করে শাসন করছে।

শরিয়াহ আইন

তালেবান আন্দোলনের মূল ভিত্তি এবং এর রাজনৈতিক লক্ষ্য সব সময় ছিল শরিয়াহ আইনের মৌলবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তিতে একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করা। শরিয়াহ আইন অ্যাডহক আদালত প্রণীত এক ধরনের ইসলামিক আইন।

এর ব্যাখ্যায় তালেবান কমান্ডার তাওয়াকুল বলেন, ‘সামরিক দায়িত্বের সঙ্গে আমাদের নাগরিক দায়িত্বও আছে। যখন আমরা কোনো অপরাধের ব্যাপারে জানতে পারি, সেই অপরাধী বা চোরকে ধরার পর কোনো জোরজবরদস্তি ছাড়া আমরা তাদের বক্তব্য শুনি, যাতে করে সে তার অপরাধ স্বীকার করতে পারে।’

এখানে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। কিছু ক্ষেত্রে তালেবান কমান্ডারদের তাদের পছন্দমতো শাস্তি কার্যকর করার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।

তাওয়াকুল যোগ করেন, ‘তার স্বীকারোক্তির পর বিচারকাজ শুরু হয়। আমাদের আদালত একটা পঞ্চায়েতের মতো। সেখানে বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকেন মুফতি ও প্রশাসনিক পর্যায়ের মতো বিজ্ঞ ব্যক্তিরা। তারা একসঙ্গে আলোচনায় বসেন। তাদের নীতিগত রায় গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে করা হয় এবং কোরআন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়।’

এদিন স্থানীয় এক ভেড়া পালকের কাছ থেকে ভেড়া চুরি ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির প্রাথমিক শুনানি দেখার জন্য আমাদের নজিরবিহীন ছাড় দেয়া হয়। অভিযুক্তকে কয়েক দিন আগে গ্রেপ্তার করে কোনো আইনি প্রতিনিধি ছাড়াই তালেবানদের কারাগারে রাখা হয়েছে।

মামলার শুনানিতে নেতৃত্ব দেন ২৭ বছরের এক তালেবান কমান্ডার। অভিযুক্তকে ঘিরেছিলেন একাধিক তালেবান যোদ্ধা। তাকে কমান্ডারের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়।

তাওয়াকুলের চড়ে মাথার টুপি পড়ে যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিটির। তাওয়াকুল তাকে বলেন, ‘আসল ঘটনা স্বীকার করো। নাহলে আমরা তোমাকে পেটাব! কোন ভেড়াটি নিয়েছ? কোথায় নিয়েছ? তুমি চুরি করেছ?... ওভাবে বলার দরকার নেই, বল যে তুমি চুরি করেছ।’

অভিযুক্ত স্বীকার করে, ‘আমি চুরি করেছি।’

লোকটির মুখের ওপরে মোবাইল ফোন ধরে তাওয়াকুল জিজ্ঞাস করেন, ‘এটা ছাড়া আর কী কী চুরি করেছ?’

‘আর কিছু করিনি’, অনুনয়ের সুরে বলে ওঠে লোকটি। ‘যদি প্রমাণিত হয়, আমার হাত কেটে ফেলেন।’

প্রাথমিক শুনানি শেষে লোকটির ক্যামেরায় দেয়া জবানবন্দি নিশ্চিতভাবেই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলবে। এখন ভ্রাম্যমাণ তালেবান বিচারক ওয়ারদাকে আসবেন চূড়ান্ত রায়ের জন্য। এ ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে জনসমক্ষে চাবুক মারা বা হাত কেটে ফেলা।

তাওয়াকুল বলেন, ‘আমরা যা কিছু শিখেছি, আমাদের সব পদক্ষেপ, আচরণ শরিয়াহ মোতাবেক এবং এর সঙ্গে একমত। এর বাইরে আর কিছু নেই।’

বিচারকে নিষ্ঠুর মনে হলেও স্থানীয়দের মধ্যে এ ধরনের দ্রুত বিচারের প্রতি এক রকম আস্থা রয়েছে। কারণ তারা একে আফগান সরকারের বিচারব্যবস্থার চেয়ে কম কলুষিত মনে করে।

এটি পরিষ্কার যে বিচারের এই ধারার বাস্তবায়ন তালেবানরা কাবুলসহ পুরো আফগানিস্তানে দেখতে চায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবানরা আফগান সরকার ও পুরো দেশকে তা অনুসরণ করতে বাধ্য করতে পারে কি না?

তাওয়াকুল বলেন, ‘(আফগান সরকারের সঙ্গে) সমঝোতার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।’

এ বিভাগের আরো খবর