লকডাউনেও বাস চলার অনুমতি মিলেছে যাত্রী কম তোলার শর্তে। বাসমালিকদের যেন ক্ষতি না হয়, সে জন্য বাড়ানো হয়েছে ভাড়া।
শুরুতে প্রতি দুই আসনে একজন যাত্রীর বিষয়টি মেনে চলা হলেও পরে সেটি আর থাকেনি। আগের মতোই দুই আসনে যাত্রী তোলার পরও বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য করছেন চালক-শ্রমিকরা।
উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় একই চিত্র দেখা গেছে।
করোনাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় প্রতি দুই আসনে একজন করে যাত্রী তুলে ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায়ের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
তবে জেলায় জেলায় যে চিত্র দেখা গেছে, সেটি হলো ৬০ শতাংশ ভাড়া আদায় করার পরও যাত্রী তোলা হচ্ছে বেশি।
এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করে ক্লান্ত যাত্রীরা প্রশ্ন তুলছেন, যদি স্বাভাবিক সময়ের মতোই বেশি যাত্রী তোলা হয়, তাহলে অতিরিক্ত ভাড়া কেন নেয়া হবে।
তবে লং রুটে (যেমন: ঢাকা-রংপুর বা ঢাকা-ময়মনসিংহ) প্রতি দুই আসনে একজন যাত্রী তুলতে দেখা গেছে।
‘পোষায় না’
বরিশালের নথুল্লাবাদের প্রভাতী পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা ইদ্রিস মিয়া বলছিলেন, যাত্রী কম নিলে তাদের পোষায় না।
তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা হইলেই মোরা ওই স্বাস্থ্যবিধি মানি। দুই সিটে একজন কইরা নিই। তয় হেতে তো আর সব সময় মোগো পোষায় না। কারণ হইছে অনেক দিন বন্ধ আছিল বাস। ওই ক্ষতি তো পোষাণ লাগবে। তাই না? নাইলে মোরা বা চলমু কেমনে আর মহাজনগো বা দিমু কী?’
সবসময় এভাবে বাসে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয় না দাবি করে তিনি বলেন, ‘যহন টাহায় শর্ট পরে তহনই উঠাই খালি।'
কিন্তু এটাকে আইনবিরুদ্ধ মন্তব্য করলে তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দামও তো বাড়ছে। এত নিয়ম-কানুন মাইনা মোগো চলতে কষ্ট অয়।’
একই কথা বলেন রুপাতলী মিনি বাস টার্মিনাল থেকে চলাচলকারী বাস আব্দুল্লাহ পরিবহনের চালক সায়েদুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘গাদাগাদি করে উঠাই না। মাঝেমধ্যে অর্ধেক যাত্রী, আবার কোনো সময় যে কয়টা সিট সেই কয়জন যাত্রী নিয়া গাড়ি চালাই।’
বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদে গিয়ে টার্মিনাল ছেড়ে চলতি পথে বাস থামিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে।
বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, ‘আমাদের যে বাসগুলো রয়েছে সেগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যারা বাস চালাবে না তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
তবে এই কঠোর ব্যবস্থা আসলে কখনও নেয়া হয় না।
ঝালকাঠি জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি সরদার মো. শাহ আলমের দাবি, তারা আইন মেনে চলছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু বাসযাত্রীদের কাছ থেকে দুটি আসনের ভাড়া নিচ্ছি, সেহেতু ওই দুটি আসনই ওই যাত্রীর। ঝালকাঠিতে সরকারি নিয়ম মেনেই আমরা বাস চালাচ্ছি।’
তবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিলন মাহমুদ বাচ্চুর বক্তব্যেই উঠে আসে আসল চিত্র। তবে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার জন্য তিনি দায় দিলেন যাত্রীদেরই।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় যাত্রীরা আলাদা বসতে চায় না। সে ক্ষেত্রে বাসের স্টাফদের কিছু করার থাকে না।’
ঝালকাঠি থেকে বরিশালগামী যাত্রী ইসরাইল হাওলাদার বলেন, বাসস্ট্যান্ডে প্রতি দুই আসনে একজন যাত্রী নিয়ে ছাড়া হলেও পথে পথে যাত্রী তোলায় আসনগুলো আর ফাঁকা থাকে না।
বরগুনা বাস মালিক সমিতির সভাপতি সগীর হোসেনের দাবি, যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিতে চায় না। তারা আগের মতোই চলছেন।
তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের টিকে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বেশি ভাড়া চাইলে যাত্রীরা বাসে ওঠে না; তারা বিকল্প যানবাহন ব্যবহার করে। এ কারণে আগের ভাড়াতেই আমরা যাত্রী পরিবহন করি।’
পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, ‘বেশি ভাড়া চাইলে যাত্রী ওডে না। কী হরমু, টিক্যা তো থাকতে তো অইবে।’
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, বাসগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না, নিয়মিত তদারকি করছে জেলা প্রশাসন। ট্রাফিক পুলিশ বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া আছে, বেশি যাত্রী নিলেই ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের শাস্তি হবে।
বাকবিতণ্ডা নিয়মিত
ভোলায় অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের নিয়মিত ঝগড়া হচ্ছে।
বাস মালিক সমিতির দাবি, আসন নেই জানার পরেও যাত্রীরাই জোর করে উঠছেন।
ভোলা ইলিশা রুট দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী ঢাকা-চট্টগাম রুটে যাতায়াত করে থাকে। সকালে সিট্রাক বা লঞ্চ ধরার জন্য চরফ্যাশনের লেতড়া, আইচা থেকে যেসব বাস আসে তার সবগুলোতেই থাকে অতিরিক্ত যাত্রী।
যাত্রী আরমান হোসেন বলেন, ‘আমি চরফ্যাশনের দক্ষিণ আইচা থেকে রওনা দিছি। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় টিকিট কাটার পরও পথে পথে যাত্রী তুলছে।’
স্বাভাবিক সময়ে চরফ্যাশন থেকে ভোলায় লোকাল বাসের ভাড়া ছিল ১০০ টাকা। সেটি বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫০ টাকা। সরাসরি বাসের ভাড়া ছিল ১৩৫ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ২১০ টাকা।
চরফ্যাশন থেকে আসা যাত্রী কাওসার হোসেন বলেন, ‘যাত্রী তো ঠিকই তোলা হয়। তাহলে শুধু শুধু ভাড়তি ভাড়া নেয়ার দরকার কী? তার চেয়ে আগের ভাড়াই হোক।’
আরেক যাত্রী অহনা বলেন, ‘আমাকে প্রায়ই বোরহানউদ্দিনে যেতে হয় বাসে করে। স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না কিছু। আবার ভাড়া ৩০ টাকার জায়গায় নেয়া হচ্ছে ৬০ টাকা।’
ভোলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো যাত্রীরা অনেক ক্ষেত্রে জোর করে বাসে উঠছেন।’
দূরপাল্লায় যাত্রী কম, লোকালে ভিড়
এই চিত্র দেখা গেছে ময়মনসিংহে।
ময়মনসিংহ পাটগুদাম বাস টার্মিনাল ও মাসকান্দা কেন্দ্রীয় আন্তজেলা বাস টার্মিনাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
বেশ কয়েকজন যাত্রী, বাসচালক, হেলপার, কনডাক্টর ও টিকিট মাস্টারের স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করার বিষয়টি একবাক্যে স্বীকারও করেছেন।
ঢাকা-নেত্রকোণা রুটে চলা বিশ্বাস পরিবহনের একটি বাস যাত্রীতে কানায় কানায় ভরা দেখা যায়। বেশির ভাগ যাত্রী, চালক ও তার দুই সহকারীর মুখে ছিল না মাস্ক।
চালকের সহকারী আল আমিন বলেন, ‘সোহাগ উস্তাদ (চালক) কইছিল মাস্ক পইরা যাত্রী তুলবার। কিন্তু যাত্রীর চাপে মাস্ক লাগানোর কথা ভুইল্যা গেছিলাম।’
ঢাকা-ঈশ্বরগঞ্জ-আঠারোবাড়ি ভায়া ময়মনসিংহের নাবিলা পরিবহনেও দেখা যায় একই অবস্থা। দৌড়াদৌড়ি করে বাসে আসন পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে যাত্রীরা। তারা গাদাগাদি করে বসেছিলেন।
কিশোরগঞ্জ এমকে সুপার কাউন্টারের টিকিটমাস্টার রিয়াদ বলেন, ‘৬০ শতাংশ ভাড়া দিয়ে চলাচলের নির্দেশ থাকলেও লোকাল বাসের কোনো যাত্রী তা দিচ্ছে না। এ কারণে গাড়ির কোনো সিট ফাঁকাও থাকছে না।’
নগরীর মাসকান্দা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
সেখানে কাউন্টারের সামনে রাখা হয়েছে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। গাড়িতে রাখা হয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ভেতরে প্রতি দুটি শয্যায় একজন করে যাত্রী মাস্ক পরে বসে আছেন।
এনা কাউন্টারের ম্যানেজার ফারুক জানান, তাদের বাসে ৪০টি আসন থাকলেও যাত্রী তোলা হচ্ছে ২০ জন। তবে পরিবার নিয়ে বসলে দুই সিটেই বসতে দেওয়া হচ্ছে। যদি কোনো যাত্রী একা আসে তাহলে তাকে দুটি আসন দিয়ে ৭০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এমনিতে ভাড়া কম ছিল।
ময়মনসিংহ জেলা মোটর মালিক সমিতির মহাসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আপনার কথা শতভাগ যুক্তিসঙ্গত। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি আমাদের বাস সংশ্লিষ্ট অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
‘এ জন্য গত শুক্রবার আমরা জরুরি আলোচনা করেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে বাসে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হবে।’
বেশির ওপর বেশি আদায়
ময়মনসিংহের মতো রংপুরেও লোকাল রুটে অতিরিক্ত যাত্রী আর ঢাকার রুটে প্রতি দুই আসনে একজন যাত্রী তুলতে দেখা গেছে।
তবে রংপুর-ঢাকা রুটে সরকারি নির্ধারিত হারের চেয়েও বেশি টাকা আদায় করতে দেখা গেছে।
ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডের হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিচ্ছি। যাত্রী বেশি নেয়া হচ্ছে না। সড়কে আমাদের চেকিং আছে।
‘আগে এক সিট (রংপুর থেকে ঢাকা) টিকেটের দাম ছিল ৫০০ টাকা। এখন দুই সিট বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা। আমরা তাই করছি।’
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫০০ টাকার ভাড়া ৬০ শতাংশ বেশি নিলে হয় ৮০০ টাকা।
এসআর ট্রাভেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের কাউন্টার ম্যানেজার রতন মিয়া জানান, আগে (রংপুর থেকে ঢাকাগামী) একটি আসন বিক্রি হতো দেড় হাজার টাকা। এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার টাকায়।
অর্থাৎ এই কোম্পানি আদায় করছে দ্বিগুণ টাকা।
লোকালে বেশি টাকা আদায় করেও অতিরিক্ত যাত্রী তোলার পেছনে পরিবহন শ্রমিকরা নিজেদের দায় অস্বীকার করেছেন।
রংপুর মেডিক্যাল মোড়, কেন্দ্রীয় টার্মিনাল, মডার্ন মোড়, কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ড, শাপলা স্ট্যান্ড, কুড়িগ্রাম স্ট্যান্ড ও সাতমাথা বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে প্রতিটি বাসেই অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে দেখা গেছে।
রংপুরের মেডিক্যাল মোড়ে ঠাকুরগাঁওগামী (মেইল) মিথিলা এন্টারপ্রাইজ বাসে যাত্রী ছিল প্রতি আসনেই।
শাহনেওয়াজ মো. শাওন নামে এক যাত্রী বলেন, ‘দুই জন বসিয়েও বাড়া বেশি নিচ্ছে।’
তাজ রহমান নামে আরেক যাত্রী বলেন, ‘আগে ভাড়া ছিল ১১০ টাকা। এখন প্রতি সিটে বসেও ভাড়া নেয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা।’
দিনাজপুরগামী বদর বাসের চালক নুরুজ্জমান দাবি করেন, যাত্রীরা মানতে চায় না। তারাই পাশাপাশি সিটে বসে যাচ্ছে।
তার দাবি, যারা দুই আসনে দুইজন বসছে তাদের ভাড়া কম নেয়া হচ্ছে। আর যারা দুই আসন নিয়ে একা যাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকেই কেবল বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে।
যদিও যাত্রী রেজাউল করিম বলেন, ‘এটা সত্য না। ভাড়া বেশিই নেয়া হচ্ছে।’
রংপুর থেকে বদরগঞ্জগামী বাসচালক জগদীশ বলেন, ‘যাত্রীরা মানে না, তাই আমরা সবাইকে তুলেছি। ভাড়া আগের মতই নিচ্ছি আমরা।’
অন্যান্য জেলার মতো এখানেও প্রশাসনের বক্তব্য গতানুগতিক।
জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, ‘গণপরিবহনে যেন ভাড়া বেশি নেয়া না হয় এবং সরকারের নির্দেশনা মানা হয়, সে জন্য আমরা কাজ করছি। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। তবু ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে।’