মাগুরা-ফরিদপুর জেলার সীমান্তবর্তী কামারখালী সেতুর দক্ষিণেই মাঝাইল গ্রাম। প্রধান সড়ক দিয়ে পাঁচ মিনিট হেঁটে গেলেই মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে খ্যাত ফররুখ আহমদের বাড়ি।
সেখানে গিয়ে দেখা গেল, কবির বাড়ির চারদিকে এখন লাল ফিতার খুঁটি দেয়া। লাল নিশান দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে কবির জন্মঘরটিও।
মধুখালী-মাগুরা রেললাইনের জন্য জমি অধিগ্রহণে এই লাল নিশানা দিয়ে গেছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এটি ঘিরে চলছে সমালোচনা। স্থানীয়রা চাইছেন, কবির বাড়ি যেন অক্ষত থাকে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মাসুদ কামাল বলেন, ‘কবির বসতভিটা রক্ষা শুধু আমাদের কাজ নয়। তিনি বাংলাদেশের একজন জাতীয় পর্যায়ের কবি। তাকে সবাই চেনে। তার জন্মভিটা আমরা আগলে রেখেছি প্রায় দেড় শ বছর। এটা আমরা ভাঙতে দেব না।’
কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরার শ্রীপুরের মাঝাইলে পৈতৃক বাড়িতে জন্ম নেন। পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ হাতেম আলীর বাড়ি এটি। এখানেই তার পূর্বপুরুষদের আদিবাস।
কাঠ ও টিন দিয়ে নির্মিত সেই বাড়িতে কবির অনেক স্মৃতি। কবি ও তার পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত একমাত্র ঘরটির আশপাশে রেললাইনের সীমানা পড়েছে। কবির স্বজনদের উদ্বেগ, কবে না ঘরদোর ভেঙে ফেলে কর্তৃপক্ষ।
রেললাইনটি ফরিদপুরের মধুখালী-কামারখালী হয়ে মধুমতী নদীর ওপর দিয়ে মাগুরা সদরের রামনগর এলাকা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ি ঘিরে চারটি লাল কাপড় বাঁধা খুঁটি মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। কবির মূল ঘরটির একটি দরজায় লাল চিহ্ন দিয়ে তীর চিহ্ন দেয়া। এ ছাড়া কবির স্বজনরা যেখানে থাকেন, সে ঘরটির বাইরের ছোট সিঁড়িতে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্নের সংখ্যা দেয়া।
ভাতিজি সৈয়দা দিলরুবা কবির বাসভবনে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। মাগুরার জেলা প্রশাসক বরাবর বসতভিটা রক্ষার আবেদনের কথা জানালেন তিনি।
পুরো বাড়ি ঘুরে দেখিয়ে বললেন, ‘এটি ছাড়া আমাদের আর কোনো বসত নেই। বাপ-দাদার স্মৃতি তো বটেই, কাকার (কবি ফররুখ আহমদ) স্মৃতি এই ঘর।’ কবির একমাত্র ঘরটির বয়স প্রায় দেড় শ বছর বলে জানান তিনি।
দিলরুবা বলেন, ‘মাগুরাতে রেললাইন সংযোগ আসছে আমরা সবাই খুশি। কিন্তু একমাত্র ভিটেবাড়ি বলতে এটাই আমাদের সম্বল। রেললাইনের সংযোগে আমাদের পুরো বাড়িটি বিশেষ করে কবির জন্মঘর, পাঠাগার, কবির পিতামাতার কবরসহ পরিবারের অন্যান্যের কবর পড়েছে। এ কারণে আমাদের পারিবারিক সবকিছুই এখন রেললাইনের সীমানায় লাল দাগে পড়ে গেছে। এ জন্য আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।’
দিলরুবা বলেন, ‘জেলা প্রশাসন আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, বাড়িটি অক্ষত রেখেই রেললাইনের কাজ চলবে। আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। সে আশায় বসে আছি।’
কবির বাড়ির প্রতিবেশী ও স্বজনরা বলেন, ‘মধুমতী নদীর ওপর দিয়ে রেলব্রিজ হবে। আমাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে। ওখান থেকে কবির বাড়ির ভেতর দিয়ে রেললাইন হবে শুনেছি। যারা সীমনা র্নিধারণের কাজে এসেছিলেন, লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছে।’
স্থানীয় মুদি দোকানি মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কবির বাড়ি দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা আসে। আমার দোকানে বসে, গল্প করে, আমাদের এলাকার গল্প শুনতে চায়। তখন প্রাণডা জুড়ায়া যায়। কবির জন্য আমরা শুধু সম্মানিত হইনে। আমার মনে হয় দেশের সবাই তার নাম জানে। সেই কবির বাড়ি আমরা কোনোভাবেই ভাঙতে দেব না।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হুমায়র রশীদ মুহিত বলেন, ‘কবির বাড়ির চারদিকে রেললাইনের সীমানা ঠিক আছে। লাল পতাকাও বাঁধা হয়েছে। বিষয়টি আমি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। তারা আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন সীমানা দাগাঙ্কিত হলেও মূল রাস্তায় কবির বাড়ির কোনো ক্ষতি হবে না। তাই চিন্তার কারণ দেখি না।’
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘কবি তো আমাদের জাতীয় পর্যায়ের কবিদের একজন। তার বাড়ি রক্ষায় তো সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিছুদিন আগেও কবির বাড়ি দেখতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য টয়লেট ও বিশ্রামাগার বানানো হলো। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কবির বাড়ির পাশ দিয়ে রেললাইন হবে।’
মাগুরার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. আশরাফুল আলম বলেন, ‘মধুখালী-মাগুরা অংশে নতুন রেললাইনের জন্য যে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে তার মধ্যে কবি ফররুখ আহমদের বসতভিটা পড়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। মাগুরার জনপ্রতিনিধিসহ নানা পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। সবার পরামর্শে প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
ডিসি বলেন, ‘কবির জন্ম নেয়া বাড়িটিসহ পুরো বাড়িটি অক্ষত রাখতে রেললাইনের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন নকশায় একটা ওভার ব্রিজ নির্মাণ দেখানো হয়েছে। কবির বাড়ির পাশ দিয়ে ওভার ব্রিজের মাধ্যমে রেললাইন চলে যাবে।’
প্রকল্প ব্যয় কিছুটা বাড়লেও কবির বাড়ির কোনো স্থাপনা ভাঙা পড়বে না বলেও জানান ডিসি।