কুষ্টিয়া সদরের বীর মুক্তিযোদ্ধার শতবর্ষী মা আছিরন নেছা। শরীর চলে না। বয়স ১০০ পার হয়েছে অনেক আগেই। ছেলের মৃত্যুর পর ঠাঁই হয়েছে গোয়ালঘরে। অন্য ছেলেরাও দেখাশোনা করেন না।
এক নাতি সাহায্য-সহযোগিতা করেন দূর থেকে। কিন্তু তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি করেন। বছরে ১০ দিনের বেশি বাড়িতে আসা হয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে আছিরনকে কে দেখবে?
এ রকম ঘটনা দেশে বিরল নয়। প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে এই ধরনের সংবাদ।
বয়স হলে অপাঙক্তেয় হয়ে যাওয়ার ঘটনা কেবল নিম্নবিত্তে নয়, আছে মধ্য আর উচ্চবিত্তেও।
আবার একাকী জীবনযাপনে বাধ্য হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে আসলে কোনো অবহেলা নয়, জীবনের বাস্তবতার দিকটি ফুটে উঠেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান নিজের ফ্ল্যাটে একাকী মারা যান। প্রতিবেশী বিষয়টি টের পান কয়েক দিন পর। ততক্ষণে মরদেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এরপর পুলিশ এসে দরজা ভেঙে সেটি উদ্ধার করে।
এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে অধ্যাপক তারেক মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে। বাসায় একা থাকতেন বলে তার চিকিৎসা হয়নি।
কাজের চাপে এখন বাবা-মাকে ছেড়ে ছেলেমেয়েদের থাকতে হচ্ছে দূরে ও আলাদা। আবার যৌথ পরিবারপ্রথা ভেঙে একক পরিবারই এখন সমাজের প্রধান প্রবণতা। আর এ কারণে শেষ জীবনে প্রবীণদের জীবন অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তাদের যত্ন-আত্তি, চিকিৎসা এমনকি খাওয়া-দাওয়ার অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়।
সমাধান কী
পশ্চিমা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশে প্রবীণ নিবাস জনপ্রিয় হয়নি। বড় শহরে সরকারি উদ্যোগে আছে হাতে গোনা দুই-একটা। বেসরকারি উদ্যোগেও সংখ্যাটি খুব একটা বেশি নয়। আবার এসব নিবাসে থাকতে চাওয়ার আগ্রহও খুব বেশি আছে এমন নয়।
প্রবীণদের ঘরে সমাদর নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাদের শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার বিষয়টি সমাজ এখনও সেভাবে মেনে নিতে পারছে এমনও নয়।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি ভালো মানের প্রবীণ নিবাস করা হয়ে থাকে তবে সেটিকে আমি খারাপ বলব না। সরকারি বা বেসরকারিভাবে সেটি করা যেতে পারে। কারণ, এখন আমাদের যে বাস্তবতা তা আমাদের পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে ছিল না।
‘তাই সময়ের সঙ্গে এটি সামঞ্জস্য রেখে চলা যাবে। যদি একটি জায়গায় এমন ব্যবস্থা করা যায় তবে সপ্তাহে সপ্তাহে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করা যাবে। খোঁজখবর রাখা। এটি কিন্তু মানানসই ব্যাপার।’
সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ জানান, সরকারের ভাবনাতেও আছে প্রবীণ নিবাসের সংখ্যা বাড়িয়ে বিপাকে পড়া প্রবীণদের শেষ জীবনটা কিছুটা হলেও স্বস্তিময় করার। তবে এই পরিকল্পনা এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। আর এ কারণে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই বিষয়টি নিয়ে কিছু জানেন না।
পশ্চিমা দুনিয়ায় এই ব্যবস্থাপনা আছে। সরকারি বা সমাজের উদ্যোগে চলে সেগুলো। সেখানে প্রবীণদের খাদ্য, বিনোদন, স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যবস্থা আছে। এমনকি শিশুদেরও সেসব নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে দুই পক্ষেরই আত্মিক বন্ধনটি বজায় থাকে।
নিবাসে থাকা মানুষদের স্বজনরা দেখতে আসেন। তারাও বেড়াতে যান সময়সুযোগমতো।
সরকার যা বলছে
পশ্চিমা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও প্রবীণ নিবাস বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম কিছু জানাতে পারেননি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রতিটি জেলা বা উপজেলাতে বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ হোম করা যাবে কি না, এমন নীতিনির্ধারণী বিষয় আমার জানা নেই। এটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে আমরা যদি এমন খোঁজ পাই যে কোনো প্রবীণ অসহায় হয়ে পড়েছেন বা তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
প্রবীণদের নিয়ে সরকারের ভাবনার কথা জানিয়েছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের একটা গাইডলাইন দিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রবীণরা বয়ঃবৃদ্ধ হলে ছেলেমেয়েরা তাদের দেখে না। উনি (শেখ হাসিনা) প্রবীণ নিবাস করে এদের সেখানে ভরণপোষণ দিয়ে ভালোভাবে রাখার পরিকল্পনা করেছেন।’
প্রথমদিকে জেলায় জেলায় এমন প্রবীণ নিবাস হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘তারপর এটি বাড়তে পারে। এটি প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা। আমরা সেটি মন্ত্রণালয় থেকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি।’
এক প্রবীণ নিবাসের চিত্র
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে একটি প্রবীণ নিবাস। সেখানে আছেন ৪৪ জন। এদের ২৩ জন পুরুষ আর ২১ জন নারী।
এদের সবার বয়সই ৭০ বছরের বেশি। আর তাদের পরিবার সচ্ছল। বাড়িতে বসবাস করা কারও জন্য বিব্রতকর, কারও ক্ষেত্রে স্বজন থাকে না কাছে। একা থাকা বিপজ্জনক।
প্রবীণ নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক আঞ্জুমান জাহিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে যারা আছেন সবাই ভালো ও সচ্ছল পরিবারের। তবে হয়তো তারা তাদের পারিবার থেকে ওই নিশ্চয়তাটুকু না পাবার কারণে এখানে নিজেদের আবদ্ধ করে রেখেছেন।’
এখানে প্রবীণরা কী করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওনারা সব সময় নিজেদের মতো করে থাকেন। আমরা কখনো তাদের এখানে আসার কারণ জানতে চাইনি। আর তারা সেটা কখনো আমাদের জানাতেও চান না। তবে আমার এইটুকু মনে হয় যে, তাদের বৃদ্ধ বয়সে তারা হয়তো কারও বোঝা হতে চান না।’
এখানে থাকার খরচ কেমন জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা জানান, এখানে ঘর ভাড়া আট হাজার টাকা। খাওয়ার খরচ তিন হাজার।
তিনি বলেন, ‘তাদের সময়মতো খাবার দেয়া হয়। যদি অসুস্থ হন কেউ তবে পরিবারকে জানানো হয়। গত বছর করোনার সময় একজন অসুস্থ হলে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে তিনি মারা যান।’
এখানে গত বছর ছিলেন মোট ৫০ জন। এর মধ্যে ৪ জন বাসায় ফিরে গেছেন। ২ জন মারা গেছেন।
আঞ্জুমান জাহিদ নিজেই বলেন, এই নিবাসের যে চিত্র, সেটি অন্য জায়গায় পাওয়া কঠিন।
তিনি বলেন, ‘আপনি অন্য কোথাও গেলে হয়তো দেখতে পাবেন সেখানে থাকার খরচ অনেক। যারা সেবা করবেন তাদের সেই মানসিকতা নেই। অনেকেই শেষ বয়সে পেনশনের টাকা দিয়ে প্রবীণ নিবাসে থাকেন। কিন্তু তারা যথাযথ যত্ন পান না।’
প্রবীণ নিবাসে যারা আছেন, তারা কেউই সাংবাদিক বা বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘আসলে তারা এর আগে অস্বস্তি অনুভব করেছেন বিধায় আমরা এখন একটু সীমাবদ্ধতা মেনে চলি। ওনারা আমাদেরও কখনো তাদের ব্যক্তিগত কথা জানাতে চান না।’
‘কেবল প্রবীণ নিবাস বাড়ানোই সমাধান নয়’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক নেহাল করিম মনে করেন, বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে যে সামাজিক রীতি চলে এসেছে, তাতে প্রবীণরা শেষ জীবনে পরিবার ছেড়ে প্রবীণ নিবাসে থাকতে চাইবেন, এমনও নয়।
তিনি মনে করেন, প্রবীণদের দায়িত্ব পরিবারের স্বজনদেরই নিতে হবে কোনো না কোনো উপায়ে।
নেহাল করিম বলেন, ‘আমরা এখনও কিন্তু ধনী হইনি। আমি নিজে খেতে পারছি না বলে আমার মাকে বা বাবাকে সাহায্য করতে পারছি না। তারপর একটা ঘরের প্রেশার থাকে।
‘যে বা যিনি মা-বাবাকে এভাবে রাখেন তাদের প্রথমত মূল্যবোধ নেই। আর তিনি যদি বউয়ের কারণেও করে থাকেন তবে তিনি ব্যক্তিত্বহীন।’
আইন কী বলে
পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারার ১ উপধারায় বলা আছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে।
২ উপধারায় বলা আছে, বাবা-মায়ের একাধিক সন্তান থাকলে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ভরণপোষণ নিশ্চিত করবেন।
৩ উপধারায় বলা আছে, বাবা-মায়ের ভরণপোষণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার সঙ্গে একই স্থানে বসবাস করতে হবে।
৪ উপধারায় বলা আছে, কোনো সন্তান তার বাবা-মাকে বা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না।
৫ উপধারায় বলা আছে, প্রত্যেক সন্তান তার বাবা ও মায়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে।
৬ উপধারায় বলা আছে, বাবা বা মা সন্তান থেকে আলাদা বসবাস করলে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তার বা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।
৭ উপধারায় বলা আছে, বাবা বা মা বা দুইজন আলাদা বসবাস করলে তার বা তাদের দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমতো, মাসিক আয় বা বার্ষিক আয় থেকে যুক্তিসংগত পরিমাণ টাকা নিয়মিত দেবে।
পিতা-মাতার ভরণপোষণ না দেয়ার দণ্ড
৫ ধারার ১-এ বলা হয়েছে, সন্তান যদি এই অপরাধ করে, তাহলে এর জন্য তার অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা তিন মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।