বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারের বাইরে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবু তার ছেলে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে রেখেছে দল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী অবশ্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে গত ১১ এপ্রিল থেকে সবার থেকে আলাদা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে এর আগেও বিএনপির নেতৃত্বকে ভারমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বিদেশে অবস্থানকারী নেতাকে নেতৃত্বে রাখাটা বিএনপির পক্ষে খুব সুখকর এমন নয়। তাকে কেবল সশরীরে পাওয়া যায় না, এটিই নয়, তার নির্দেশনার কথা কেবল বিএনপি জানাতে পারে, কিন্তু তার কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা যায় না।
দণ্ডিত ও পলাতক আসামি হিসেবে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রকাশে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে।
তারেক রহমান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা ছাড়াও অর্থ পাচার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এবং সব শেষ বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির মামলায় দণ্ডিত।
এর মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তার।
২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়ার পরের বছর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে গিয়ে আর ফেরেননি তারেক। জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে সে দেশে রয়ে যান। এর মধ্যে তার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যাওয়ার দুই বছর পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সাময়িক মুক্তি পেয়ে খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় থাকছেন। তার কাছে চাইলেই যেতে পারছেন বিএনপির নেতারা।
এই অবস্থাতেও তার বদলে বিদেশে অবস্থানকারী তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে রাখার বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না বিএনপি।
সাজার আগে আদালতে হাজিরা দিতে খালেদা জিয়া- ফাইল ছবি
কী বলছেন বিএনপি নেতারা
খালেদা জিয়া মুক্ত থাকা সত্ত্বেও তারেক রহমান কেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে এমন প্রশ্ন শুনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিরক্ত হয়েছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপনারা অসময়ে অহেতুক আলাপ সামনে নিয়ে আসেন। এটা কোনো প্রশ্ন না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারেক রহমান চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। ম্যাডাম দীর্ঘদিন কারাবাসে ছিলেন, অসুস্থ ছিলেন। তিনি তো এখন হাসপাতালেই ভর্তি। তার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান এ দায়িত্ব পেয়েছেন। এখানে প্রশ্ন থাকার কিছু নেই।’
অসুস্থ থাকার আগে তো বেগম জিয়া সাময়িক মুক্তিতে ছিলেন, তখনও তো বেগম জিয়াকে পুনরায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি? এমন প্রশ্নে গয়েশ্বর বলেন, ‘সাময়িক মুক্তি। এই সাময়িক মুক্তির পিছনে অনেক হিডেন বার্তা রয়েছে। তিনি তখনও বন্দিই ছিলেন। বন্দি অবস্থায় একজন কীভাবে দলের দায়িত্ব নেবেন? প্রতিবন্ধকতার কারণে তো দলীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকতে পারে না। দলকে সক্রিয় রাখতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে তা গঠনতন্ত্রের বাইরে নয়।’
বিএনপি নেত্রীকে গত বছরের মার্চে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার পর আরও দুই দফা ছয় মাস করে বাড়ানো হয়েছে মুক্তির মেয়াদ। তিনবারই সরকার ও বিএনপি নেত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে দুটি শর্তের কথাই বলা হয়েছে।
সেগুলো হলো
০১. বিএনপি নেত্রী দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন
০২. তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না
গত ২৭ এপ্রিল বিএনপি নেত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর পরিবারের পক্ষ থেকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার আবেদন করা হয়। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দণ্ডবিধির ৪০১ ধারা ব্যবহার করে বিএনপি নেত্রীকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হয়েছে। এই ধারায় দ্বিতীয়বার আর কোনো কিছু করার আইনি সুযোগ নেই।
তবে গয়েশ্বর দাবি করেছেন, এই দুই শর্তের বাইরেও ‘হিডেন (গোপন) শর্ত’ আছে।
তবে কী সেই হিডেন শর্ত? এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। বলেন, ‘সেটা আপনারা খুঁজে বের করেন। আপনারা তো গণমাধ্যম। একজন অসুস্থ সেটা জনগণ দেখছে। তার চিকিৎসার জন্যও বাধা যেখানে, সেখানে আর কী বলা যাবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খালেদা জিয়া আন অফিশিয়ালি এখনও তার জায়গাতেই আছেন। তার ভাবমূর্তি ঠিক ঐ জায়গাতেই আছে, যেখানে ছিল। কেউ তাকে সরিয়ে রাখেননি। তাকে সরানোর এখতিয়ারও কারও নেই। তিনি চাইলে যেকোনো সময় চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিতে পারেন। এখন তিনি অসুস্থ। এই মুহূর্তে তাকে সুস্থ দেখাটাই সবার কামনা।’
তারেককে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করতে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন
বিএনপি নেত্রীর কারাদণ্ড হয় ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাতেই তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে বিএনপি।
তারেককে এই পদ দিতে দলের গঠনতন্ত্রও পাল্টায় দলটি। আগের গঠনতন্ত্রে ছিল দণ্ডিত কেউ দলের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবে না। তবে কোনো আগাম ঘোষণা না দিয়ে অনেকটা চুপিসারে সংশোধিত গঠনতন্ত্র দিয়ে আসা হয় নির্বাচন কমিশনে। এ নিয়ে সে সময় ক্ষমতাসীন দলের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয় বিএনপিকে, যার জুতসই কোনো জবাব নেতারা দিতে পারেননি।
বিএনপি উচ্চ আদালতে গিয়ে আইনি লড়াইয়ে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে পারেনি, উল্টো জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ড বেড়ে ১০ বছর হয় হাইকোর্টে। এরপর আপিলের মীমাংসায় বিএনপি আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
পাশাপাশি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজা হয়েছে সাত বছর। এই মামলায় হাইকোর্টে আপিল শুনানিতেও বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই।
আইনি লড়াইয়ে ব্যর্থতা বা নিস্পৃহ মনোভাবের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী তৎপর হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ছুটে যান। আর মানবিক কারণে সাড়া দেন সরকারপ্রধান।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাসায় ফেরার দিন খালেদা জিয়া-ফাইল ছবি
মুক্ত খালেদা রাজনীতি থেকে দূরে
গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর সরকারপ্রধানের নির্বাহী আদেশে ২৫ মার্চ দণ্ড ছয় মাসের জন্য মওকুফ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরেন বিএনপি নেত্রী।
সেদিনের পর কেবল এক দিন বিএনপি নেত্রীর রাজনৈতিক বৈঠকের খবর আসে গণমাধ্যমে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনায় রাজনৈতিক আলোচনা হওয়ার খবর অসত্য বলে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়।
যে খবর গণমাধ্যমে এসেছিল, তাতে বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো কথা লেখা ছিল না। বলা হয়েছিল, খালেদা জিয়া তার কারাগারে থাকা অবস্থায় দলের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন আর কিছু সিদ্ধান্ত যে তার পছন্দ হয়নি, সেটি বলেছেন।
কেবল প্রতিবাদলিপি নয়, বিএনপির একাধিক নেতা নানা আয়োজনে বারবার বলেছেন, সেই বৈঠক ছিল কুশলবিনিময়, সেখানে রাজনীতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
তবে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হলে কী সমস্যা, সে বিষয়ে নেতারা কিছু বলেননি।
সেদিনের পর থেকে খালেদা জিয়া দলের নেতাদের সঙ্গে আর কোনো বৈঠক করেননি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ গিয়েছেন তার বাসভবন ফিরোজায়।
দলের কোনো আলোচনায় ভার্চুয়ালি বিএনপি নেত্রী অংশ নিয়েছেন, এমন খবরও জানানো হয়নি। দলের বিজ্ঞপ্তিতে এসব বৈঠকে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন তা জানানো হয়। তবে খালেদা জিয়ার নাম কখনও লেখা হয়নি।
স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস- এর কোনো একটি দিবসেও খালেদা জিয়া বাণী দেননি। এমনকি ঈদের শুভেচ্ছাও জানাননি।
গত ১৩ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা তো মনে করি, উনি এখনও অ্যাকটিভ আছেন রাজনীতিতে। শি ইজ অলওয়েজ ইন আওয়ার মাইন্ড। উনি রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় প্রভাবের নাম। বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে কখনও সরে যাননি এবং যাবেন না। আমরা মনে করি, উনি আছেন, উনি থাকবেন। যখনই উনি সুস্থ হবেন, বেরিয়ে আসবেন, অবশ্যই উনি অ্যাকটিভ হবেন।’