করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের জন্য একের পর এক সংকুচিত হয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক আকাশপথ। এর ফলে দেশি এয়ারলাইনসগুলো তাদের বহরে থাকা উড়োজাহাজের সক্ষমতার দুই-তৃতীয়াংশই ব্যবহার করতে পারছে না।
তার ওপর প্রতিনিয়তই উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ও লিজের টাকা শোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ফ্লাইট না চালিয়েও গুনতে হচ্ছে এয়ারপোর্ট পার্কিং ফিসহ সরকারের অন্যান্য মাশুল। এ অবস্থায় বড় ঝুঁকির মুখে পড়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ দেশি এয়ারলাইনসগুলো।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানের বহরে বর্তমানে রয়েছে ২১টি উড়োজাহাজ। এর মধ্যে নিজস্ব ১৫টি আর ভাড়ায় আনা হয়েছে ছয়টি।
নিজস্ব উড়োজাহাজের মধ্যে আছে ছয়টি বোয়িং সেভেন এইট সেভেন ড্রিমলাইনার, চারটি ট্রিপল সেভেন, দুটি সেভেন এইট সেভেন ও তিনটি ড্যাশ এইট মডেলের উড়োজাহাজ। ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজগুলোর মধ্য চারটি সেভেন থ্রি সেভেন ও দুটি ড্যাশ এইট।
ড্রিমলাইনার ও ট্রিপল সেভেন উড়োজাহাজগুলো একটানা ১৬ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম। মূলত লম্বা দূরত্বের গন্তব্যে এ উড়োজাহাজগুলো ব্যবহার করা হয়। সেভেন থ্রি সেভেন মধ্য দূরত্ব ও ড্যাশ এইট সাধারণত ব্যবহার করা হয় স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে।
বিমান বলছে, করোনার কারণে উড়োজাহাজগুলোর সক্ষমতার দুই-তৃতীয়াংশও এখন ব্যবহার করা যাচ্ছে না। করোনার আগে ১৭টি আন্তর্জাতিক রুটে নিয়মিত ছিল বিমানের ফ্লাইট, যার বেশির ভাগই এখন বন্ধ।
সংস্থার জনসংযোগ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার আগে উড়োজাহাজের দৈনিক গড় ব্যবহার ছিল প্রায় নয় ঘণ্টা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৯ ঘণ্টায়। আন-অডিটেড হিসাবে গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিমানের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭৯ কোটি টাকা।’
ঘাটতি কমাতে গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্গো ও চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করেছে বিমান। এরপরও লোকসান ঠেকানো যায়নি।
তাহেরা খন্দকার বলেন, ‘ঘাটতি কমাতে বিমান কার্গো এবং চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনার গৃহীত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া বিমানের যানবাহন বিভাগ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগ এবং মোটর ট্রান্সপোর্ট বিভাগকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনাবশ্যক এমন মূলধন জাতীয় খরচ বা ব্যয় সংকোচন করা হচ্ছে এবং বিমানের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের বেতন কর্তন অব্যাহত আছে।
‘বিমানের যানবাহন বিভাগ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগ এবং মোটর ট্রান্সপোর্ট বিভাগকে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্য এগুলো থেকে রাজস্ব আয় মূল লক্ষ্য নয়। তবে প্রিন্টিং প্রেস, পোলট্রি এমটি বাণিজ্যিকীকরণের ফলে নিজেরাই প্রফিট করছে এবং তাদের সক্ষমতাও বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের স্বাধীনভাবে আয় করারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
বেসরকারি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনার কারণে আন্তর্জাতিক রুটে তাদের সক্ষমতার ৭৫ ভাগই ব্যবহার করতে পারছে না। এয়ারলাইনসটির বহরে বর্তমানে রয়েছে ১৪টি উড়োজাহাজ। অন্তত চারটি উড়োজাহাজ মধ্য দূরত্বের গন্তব্যে উড়তে সক্ষম।
এয়ারলাইনসটির জনসংযোগ ও বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা সামনে এসেছে, সেটি হলো একটি ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এখানে শুধু যে আমরা সাফার করছি, এমনটা নয়। পুরো এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিটাই ধ্বংসের মুখে।
‘বাংলাদেশি এয়ারলাইনসগুলো পুরো বাজারের যতটুকু নিয়ন্ত্রণ করছিল, এখন সেই বাজার নেই বললেই চলে। নানা বিধিনিষেধের কারণে দেশি এয়ারলাইনসের বাজার চলে যাচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইনসের কাছে। গত বছর থেকেই বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ৭৫ ভাগের মতো সক্ষমতা হারিয়েছি। এটি এখনও অব্যাহত আছে।’
তবে এর মধ্যেও আন্তর্জাতিক রুটে চার্টার্ড ও কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করে আয় করার কথা জানান ইউএস-বাংলার এ মুখপাত্র। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতেও জোর দিয়েছে এয়ারলাইনসটি।
তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু রুটে স্পেশাল বা চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ আমরা পেয়েছি। এগুলো কিছুটা রেভিনিউ জেনারেট করছিল। বেশ কিছু কার্গো ফ্লাইট আমরা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতায় পরিচালনা করেছি। নিয়মিত ফ্লাইট শুরুর পর অক্টোবর থেকে আমরা কিছু রেভিনিউ পেয়েছি।
‘কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কা যখন এল, ভিসা রেস্ট্রিকশন শুরু হলো। অনেক জায়গায় এমবার্গো, কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতা এগুলোকে মাথায় রেখে ধীরে এগোতে হচ্ছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলো থাকার কারণেও আমরা কিছু রেভিনিউ পাচ্ছিলাম।’
দেশি এয়ারলাইনস টিকিয়ে রাখতে সরকারের বিভিন্ন ফি মওকুফের দাবি জানান কামরুল।
তিনি বলেন, ‘আমাদের টিকিয়ে রাখতে সরকারের কিছু সুবিধা অবশ্যই দেয়া উচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের অ্যারোনটিক্যাল-নন অ্যারোনটিক্যাল যে চার্জগুলো আছে, সেগুলো যদি কিছুটা কমানো যায় তাহলে সহায়তা হবে।
‘একটি ফ্লাইটের পরিচালন ব্যয়ের ৪০ ভাগই জ্বালানি ব্যয়। গত বছরের আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চারবার ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রতি লিটারে এখন প্রায় ১৪ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। এগুলো বৃদ্ধি পাওয়া মানে ফ্লাইটের খরচ বেড়ে যাওয়া। এর প্রভাব টিকিট-ভাড়াতেও পড়ছে। এ ছাড়াও এই সময়ে ডেভেলপমেন্ট চার্জের মতো একটি চার্জও যুক্ত করা হয়েছে। এটিও কিন্তু যাত্রীদের ঘাড়ে পড়েছে।’
অবশ্য আকাশপথের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, দেশি এয়ারলাইনসকে টিকিয়ে রাখতে আন্তরিকতার অভাব নেই।
সংস্থার চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সব এয়ারলাইনসকেই সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। যখনই কোনো রুট খুলছে, আমরা দেশি এয়ারলাইনসগুলোর জন্য বেশি করে ফ্লাইটের ব্যবস্থা করছি। যারা আমাদের অ্যালাউ করছে না, সেখানে আমাদের কিছু করার নেই।’
এয়ারলাইনসে ফি মওকুফের চেষ্টাও চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা গত বছর কোভিডের জন্য এয়ারলাইনসগুলোর ফি মওকুফ করেছিলাম। এটা আবার আমাদের রেভিনিউ আয় থেকে অ্যাডজাস্ট করতে হচ্ছে। এ কারণে এটার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়েছিল।
‘এ বছরও আমরা দেখছি কী পরিমাণে এটা করতে পারি। অর্থ বিভাগে কী পরিমাণ অনুমোদন দেয়, সেটার ওপর নির্ভর করছে ফি মওকুফের বিষয়টি। তবে আমাদের জায়গা থেকে উদ্যোগ আছে।’
তিনি বলেন, ‘এবার আন্তর্জাতিক রুটে কিছু ফ্লাইট চলেছে। অভ্যন্তরীণে কিছুদিন ফ্লাইট বন্ধ ছিল। সেটা আমরা অবশ্যই বিবেচনায় আনব।
‘ফি মওকুফ করতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব রাজস্ব আহরণেও হাত পড়ে যাচ্ছে। এ জন্য হয়তো সব দাবি পূরণ করা যাবে না। তবে আমরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আমরা চেষ্টা করব কতটা সুযোগ দেয়া যায়।’