বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

১০ কোটি টাকার প্রকল্পে ২ কোটি টাকার গাড়ি

  •    
  • ২৯ মে, ২০২১ ২১:০৩

লালমনিরহাটে দেশের প্রথম এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তৈরির জন্য যে সমীক্ষা প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে মোট ব্যয়ের ২১ শতাংশই যাবে গাড়ির পেছনে। পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি বলছে, এত ছোট প্রকল্পে শুধু গাড়ির পেছনেই এত ব্যয় যৌক্তিক নয়।

দেশের প্রথম এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছে এক বছর হলো। ঢাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম শুরু হলেও এর স্থায়ী ক্যাম্পাস হবে উত্তরের জেলা লালমনিরাহাটে।

প্রায় ৬৪০ একর জমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের প্রাথমিক কাজ হিসেবে সমীক্ষা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। ১০ কোটি টাকারও কম ব্যয়ের সমীক্ষা প্রকল্পে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ চাওয়া হয়েছে গাড়ির পেছনে। এতে গাড়ি কেনা, নিবন্ধন, রক্ষণাবেক্ষণ ও তেলের পেছনেই যাবে ব্যয়ের ২১ শতাংশ অর্থ।

এক বছরে বাস্তবায়নযোগ্য ছোট এই প্রকল্পে বড় অঙ্কের গাড়ি কেনা ও তার ব্যয় এবং অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত প্রাক্কলন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। আবার এভিয়েশন-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প হলেও তাতে অ্যারোস্পেস-এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ পরামর্শকও রাখা হয়নি, যা নিয়েও আপত্তি রয়েছে কমিশনের।

আগামী ২ জুন অনুষ্ঠেয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় (পিইসি) আপত্তি বিষয়ে জানতে চাইবে কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোসাম্মৎ নাসিমা বেগমের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার হাড়িভাঙা এলাকায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়’- বিএসএমআরএএইউর স্থায়ী ক্যাম্পাস হবে। এ জন্য ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি ডিভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যের আলোকেই হবে মূল কাজের ব্যয় প্রাক্কলন।

কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ছোট এই প্রকল্পতেও অনেক খাতেই অতিরিক্ত ব্যয় চাওয়া হয়েছে। এমন একটি প্রকল্পে যদি এক-চতুর্থাংশ গাড়িতেই ব্যয় হয়, সমীক্ষার অন্য কাজের কী হবে? ইচ্ছেমতো ব্যয় করতে চাইলে তো হবে না। পরিকল্পনা কমিশনসহ অন্যদের নিয়ে প্রকল্প ব্যয় যাচাই-বাছাইয়ে কমিটি আছে। এ কমিটির সভায় সব দিক বিবেচনা করে যা যৌক্তিক হবে, তাই দেয়ার সুপরিশ করা হবে। তবে অবাস্তব আবদার করাও উচিত নয়।’

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশের প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যয় নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। এগুলোতে প্রচুর অনিয়ম হয়, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রচুর ব্যয় করা হয়। এর অন্যতম হচ্ছে গাড়ি কেনা। এগুলো প্রকল্প পরিচালকসহ শীর্ষ ব্যক্তিরাই ব্যবহার করেন। যদিও সেগুলো তেমন প্রয়োজন হয় না। কারণ তারা প্রকল্প এলাকায় থাকেন না। তা ছাড়া প্রয়োজনে দু-একটি গাড়ি হায়ার (ভাড়া) করলেই হয়।’

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার লোকেরা এসে হোটেলে থেকে ভাড়া গাড়ি নিয়ে সমীক্ষার কাজ করেন। কিন্তু আমাদের লোকেরা তা পারেন না। তাদের গাড়ি কেনা লাগেই।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, যা বাংলাদেশের এভিয়েশন এবং অ্যারোস্পেস (মহাকাশ) সম্পর্কিত প্রথম এবং একমাত্র উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিমানশিল্পে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই দক্ষ বৈমানিক, বিমান প্রকৌশলী, বেসামরিক বিমান পরিবহনের সব স্তরের দক্ষ জনবল, বিমান তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়, মহাকাশ-সম্পর্কিত বিভিন্ন স্তরের উচ্চশিক্ষা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া হবে।

সমীক্ষা প্রকল্প প্রস্তাবানায় দেখা যায়, সমীক্ষা প্রকল্পের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার টাকায় দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কেনার কথা বলা হয়েছে, যা মোট ব্যয়ের ১৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। তেলের জন্য ১৮ লাখ টাকা বা ১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং প্রায় ১২ লাখ টাকা বা দেড় শতাংশ অর্থ চাওয়া হয়েছে গাড়ির নিবন্ধন ও রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে। সব মিলিয়ে গাড়ির পেছনেই খরচ হবে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা বা ২১ শতাংশ।

প্রস্তাবিত সমীক্ষা প্রকল্পে অন্য ব্যয়ের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের জন্যও ৫৮ লাখ টাকা রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এক বছরের জন্য নেয়া এই প্রকল্পে ৮ লাখ টাকার অফিস সরঞ্জাম, দেশে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের পেছনে ৬ লাখ টাকা, ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকার প্রিন্টিং ও বাইন্ডিং ব্যয়, ২ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন ব্যয় এবং ৪ লাখ টাকা বিনোদন ব্যয় ধরা হয়েছে।

এ ছাড়া পরামর্শক খাতে ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা, জরিপকাজে ২ কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ম্যানেজমেন্ট খাতে ২১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, সম্মানী ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ অন্যান্য ব্যয়ও রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে গাড়ির পেছনে খরচ নিয়ে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন নিজেদের মতামতে বলেছে, প্রকল্পটি স্বল্প বাজেটের। তাই এতে এত বেশি টাকা গাড়ির পেছনে ব্যয় করা উচিত নয়। প্রকল্প ব্যয়ে গাড়ি কেনার পেছনে ১৮ শতাংশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও তেলের পেছনে আরও ৩ শতাংশসহ মোট ২১ শতাংশ ব্যয় যৌক্তিক বা সমীচীন নয়। সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের জন্য প্রকল্পের প্রয়োজনে এক বছর মেয়াদে গাড়ি ভাড়া করার প্রস্তাব করা ছিল যুক্তিযুক্ত। এ সম্পর্কে পিইসি সভায় সংস্থার প্রতিনিধির কাছে জানা যেতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের এভিয়েশন-সংক্রান্ত পড়ালেখার প্রয়োজন আছে। তবে এত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে নতুন আরেকটি প্রয়োজন কি না, তা দেখা উচিত ছিল। বিদ্যমান প্রতিটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-সম্পর্কিত আলাদা বিভাগ বা কোর্স খুলেও তা চালানো যেত। কারণ এসব বিষয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও গ্র্যাজুয়েটসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জানাশোনা মানবসম্পদ অছে কি না, তা দেখতে হবে। সমীক্ষা প্রকল্পে গাড়ি কেনার প্রয়োজন নেই বলেও মনে করি আমি।’

সমীক্ষা কার্যক্রমে অধিক পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ প্রয়োজন বলে মির্জ্জা আজিজুল মন্তব্য করেন। আবার আকাশপথ ও মহাকাশ-সম্পর্কিত প্রকল্প হলেও তাতে একাধিক আরবান প্ল্যানার বা পরামর্শক রাখা হয়েছে, কিন্তু কোনো এভিয়েশন-অ্যারোস্পেস বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়নি। এতে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমীক্ষা করার কথা বলা হলেও পৃথক পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব বিষয়ে যৌক্তিকতা সংস্থার প্রতিনিধির কাছে জানতে চাইবে কমিশন।

সমীক্ষা প্রকল্প শুরু করতেও বিলম্ব হয়েছে। প্রথমে প্রকল্পটি সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত এক বছর বাস্তবায়ন সময় ধরা হয়েছিল। এরই মধ্যে যা প্রায় পার হয়ে গেছে। অর্থাৎ সমীক্ষা শুরুর আগেই সময় বাড়বে। তা ছাড়া প্রস্তাবনায় মাত্র এক বছরে অনেক বিষয়ে তথ্য যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পে দুটি বাস্তবায়নকারী সংস্থার কথা বলাও হয়েছে।

অন্য খাতের ব্যয় নিয়ে কমিশন বলছে, বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক হওয়া প্রায়োজন। ম্যানেজমেন্ট চার্জ হিসেবে ফিজিবিলিটি কমিটির মিটিং, পিইসি/টিইসি মিটিং, ড্রইং অ্যাপ্রুভাল কমিটির মিটিংয়ের সম্মানী নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। ফরেন ট্যুর, এন্টারটেইনমেন্ট এক্সপেন্স, সেমিনার ও কনফারেন্স এক্সপেন্স, কনভেইয়েন্স, ট্যুর-ট্রাভেল (অভ্যন্তরীণ), প্রিন্টিং ও বাইন্ডিং, অনারিয়াম বা সম্মানী ইত্যাদি খাতের ব্যয় যৌক্তিক করা এবং এসব ব্যয়ের বিস্তাবিত বিবরণ সম্পর্কে সভায় আলোচনা হতে পারে।

২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংসদে এ-সম্পর্কিত বিল পাসের পর দেশের প্রথম এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়টি পরের বছরের (২০২০ সাল) জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে। ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর এলাকায় স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন ও পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়।

প্রথম ব্যাচে বিএসসি এন অ্যারোনিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, এমএসসি ইন এভিয়েশন সেফটি অ্যান্ড অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন এবং এমবিএ ইন এভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট– এই তিনটি বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্বে রয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল এ এইচ এম ফজলুল হক।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে লালমনিরহাটে বিএসএমআরএএইউর অস্থায়ী ক্যাম্পাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বিমানবাহিনী-প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত। লালমনিরহাটে মূল ক্যাম্পাসের পাশাপাশি ঢাকার আশকোনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা থাকবে।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আন্তর্জাতিক মান দিতে আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোম্পানি, এভিয়েশন কোম্পানি ও এভিয়েশন অথরিটি, ইউরোপীয় বহুজাতিক কোম্পানি এয়ারবাসের সঙ্গে সহযোগিতার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এ ছাড়া শীর্ষ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন কভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি, সারে ইউনিভার্সিটি এবং জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টারসহ ইউরোপের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণায় সহযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের আদলে এই ক্যাম্পাস নির্মাণকাজ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর