করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকাতে লকডাউন মানুষের জীবনে উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা নিয়ে এলেও চিড়িয়াখানার প্রাণীরা আছে নির্বিবাদে। নিরিবিলি পরিবেশে তৈরি হয়েছে একান্ত সময় কাটানোর সুযোগ, সঙ্গী আর সঙ্গিনীর মাঝে বেড়েছে সখ্য।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের আশা, আগের বারের বন্ধ সময়ের মতোই এবারও ফুরফুরে মেজাজে থাকা প্রাণীরা উপহার দেবে নতুন শাবক। যত দিনে আবার খুলবে চিড়িয়াখানার বন্ধ দরজা, তত দিনে বেশ কিছু নতুন প্রাণ আলো দেখবে পৃথিবীর।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ২০ মার্চ ঢাকায় দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার দরজা। প্রায় সাত মাস পর ১ নভেম্বর সেটি আবার দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই দীর্ঘ অবকাশে ১১৬টি শাবক উপহার দিয়েছিল চিড়িয়াখানার প্রাণীরা।
আরও পড়ুন: করোনায় চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের ‘হানিমুন’
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে গত ১ এপ্রিল থেকে আবার বন্ধ বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা। এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় তিন মাস। এই সময়ে ডিম দিয়েছে ময়ূরী। কর্তৃপক্ষ বলছে, সামনের দিনগুলোতে আরও বেশ কিছু প্রাণী বাচ্চা দেবে বলে তারা আশাবাদী।
চিড়িয়াখানার বন্ধ দরজার ভেতরে প্রাণীদের দিন কেমন কাটছে, খোঁজ নিয়েছে নিউজবাংলা। ১৮৬ একরের এই স্থাপনা জুড়ে এখন সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে ময়ূর আর ইমুর হাঁকে তৈরি হয় গা ছমছম অনুভূতি।
চিড়িয়াখানায় আয়েশি সময় কাটছে জলহস্তীরদর্শকের ভিড়, হইচই বহুদিন নেই, তাই অলস সময় জমিয়ে উপভোগ করছে প্রতিটি প্রাণী। কয়েক দিনের গরম কিছুটা অস্থিরতা তৈরি করলেও বেশির ভাগ প্রাণীর তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই।
জলহস্তীদের দেখা গেল আয়েশ করে পানিতে ডুবিয়ে আছে শরীর। বাঘ, হাতিদের কোনো তাড়া নেই, ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। তবে দুরন্তপনা এতটুকু কমেনি হরিণ আর জেব্রার।
বাঁদরের বাঁদরামি কমেছে
চিড়িয়াখানায় ঢুকতেই সবার আগে চোখে পড়ে বানর। তবে গরম বাগড়া দিয়েছে তাদের বাঁদরামিতে। দর্শনার্থীর কাছ থেকে নিষিদ্ধ খাদ্যদ্রব্য নেয়ার সুযোগ নেই বলে তাদের লাফঝাঁপও বেশ কম। দেখা গেল, নেট ঘেরা খাঁচার একপাশে ছায়ার মধ্যে সবগুলো একসঙ্গে গাদাগাদি করে ঝুলে আছে। কেউ কেউ ব্যস্ত সঙ্গীর সাথে খুনসুটিতে।
তবে ব্যতিক্রম ইমু পাখি। ক্যামেরা দেখেই এগিয়ে আসে ছবি তোলার জন্য। ইমু পাখির মতো ক্যামেরাতে আগ্রহ রয়েছে উট পাখি ও ময়ূরের।
অবসরের ঘুম থেকে জেগে ওঠা বাঘের ঢুলুঢুলু চোখঘুমকাতুরে বাঘ
শান্ত পরিবেশে বাঘের আগ্রাসী রূপও এখন উধাও। সকালের খাবারের পর এক ঘুমে পেরিয়ে যাচ্ছে দুপুর। বাঘের মতো আলস্য ভর করেছে আরও অনেক প্রাণীতেও। তবে জিরাফ ও জেব্রা যেন মানুষ দেখতে এখনও উৎসুক।
হাতির খাঁচার গেট খোলা। কাছে গিয়ে দেখা যায়, সব হাতিকেই শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ছায়াতে। অন্যদিকে শীতল প্রাণী সাপও চুপচাপ। গন্ডার ঘুমিয়ে আছে। পানি আর কাদা মিশে একাকার তার শরীর।
চিড়িয়াখানায় গাধারা যেন একটু বেশি শান্ত। আপন মনে বিচরণ করছে তারা। এদের একটি এগিয়ে আসে ক্যামেরা দেখে।
ইমু পাখির ১৪টি বাচ্চা এসেছে চিড়িয়াখানায়বেড়েছে সখ্য
গত বছর লকডাউনে প্রায় সাত মাসের বন্ধে ১১৬টি শাবক জন্ম নিয়েছিল জাতীয় চিড়িয়াখানায়। এবারও একই ধরনের ঘটনার আশা করছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর লকডাউনে আমরা ১১৬টি নতুন প্রাণী পেয়েছি। এবার ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত ৪২টি নতুন পশুপাখি আমাদের এখানে সংযোজিত হয়েছে।
‘এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জলহস্তীর একটা, জেব্রার দুটি, আফ্রিকান হাতির দুটি বাচ্চা, বকের বাচ্চা, ১৪টি ইমু পাখির বাচ্চা। এ ছাড়া ময়ূরীর ১৬টি ডিম থেকে বাচ্চা হয়েছে। হ্যাচারিতে এখনও প্রায় ১০০ ময়ূরের ডিম রয়েছে। এর থেকে ৩০ ভাগ ফোটার সম্ভাবনা রয়েছে।’
এবারের লকডাউনেও প্রাণীদের প্রজনন বাড়বে আশা করে তিনি বলেন, ‘সব সময় কিছু অতিউৎসাহী দর্শক থাকেন যারা ভেতরে প্রাণীদের উত্ত্যক্ত করেন। হাততালি দেন, হুমকিধমকি দেন। এটা এখন আর হচ্ছে না। অন্যদিকে আমাদের খাদ্যব্যবস্থাও আগের চেয়ে উন্নতমানের। এ দুটি কারণে প্রাণীর যৌন চাহিদাও বেড়েছে। যার ফলে প্রজনন বৃদ্ধি পেয়েছে।’
চিড়িয়াখানার নিরিবিলি পরিবেশে ভালোই কাটছে জেব্রারবাগড়া দিচ্ছে গরম
গরমে প্রাণীদের অস্বস্তির কথা জানান আব্দুল লতিফ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খাবার পেলেই বিশ্রামে চলে যায় বন্য প্রাণীরা। গরমের কারণে বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। বন্য প্রাণীরা ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটায়। এরা মূলত খাবারের জন্যই শিকারে বের হয়। এখানে আটকা থাকার ফলে তাদের সেটিও করতে হয় না। আমরা এখানে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে খাবার দিয়ে ফেলি। তাই ১২টার পর এদের আর বাইরে দেখা যায় না।’
বন্ধ থাকলেও চিড়িয়াখানার স্বাভাবিক রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলছে আগের মতোই। ফলে দর্শনার্থী না থাকায় রাস্তার চারপাশের সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে।
আব্দুল লতিফ বলেন, ‘চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকলেও আমাদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে। গরম প্রতিবছরই আসে। এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। আমরা মার্চ মাসের ১৫ তারিখের পর থেকেই ব্যতিক্রমী কিছু কাজ করে থাকি। গরম থেকে প্রাণীদের রক্ষা করতে শেডের মধ্যে পানি ছিটিয়ে দিই। ছাদে খড় রাখি। শেডের গেটে ছালা ভিজিয়ে রাখি।
‘এ ছাড়া প্রাণীদের খাবারেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। দুই বেলা তাদের খাবার দেয়া হয়। তাপমাত্রা বেশি থাকলে প্রাণীরা খেতে চায় না। তাই খুব সকালে ও বিকেলে খাবার দেয়া হয়। রসাল ফলের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এ ছাড়া প্রাণীদের খাবারের সঙ্গে স্যালাইন দেয়া হয়।’
চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনায় প্রতিকূলতা না থাকলেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে বলে জানান আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে বাজেটের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রশিক্ষিত জনবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২৭০ লোকবল থাকার কথা থাকলেও ১৭০ জনকে নিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে।’