বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ডলির স্কুল কি বাঁচবে?

  •    
  • ২৫ মে, ২০২১ ১৬:২৬

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করতেই হতাশার সুরে ডলি বলেন, ‘সমাজের লাজলজ্জা ভুলে নিরুপায় হয়ে এই দোকান দিয়েছি। করোনার মধ্যে স্কুল চালাতে ৩০ লাখ টাকা ঋণ করেছি। প্রতি মাসে এক লাখ টাকা করে ঋণ বাড়ছে। মাথার উপর এই দেনা নিয়েই বেঁচে আছি। টাকার অভাবে ছেলেকে আর ভার্সিটিতে পড়াতে পারছি না। মেয়েরও লেখাপড়া বন্ধ। সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছি না।’

‘এই খেলনার দোকান থেকে যা আয় করি সেটা দিয়ে কোনো রকমে পেট চালাই। কিন্তু স্কুলের ভাড়া দিতে পারি না। প্রতি মাসে স্কুলের ভবন ভাড়া বাকি রাখি। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল দিতে হয়। ধারদেনা করে এত দিন চালিয়ে এসেছি, এখন আর পারছি না। আর কিছু দিন দেখব, তারপর সব ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’

কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবরের গ্রীন লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক নুর আক্তার ডলি, যে প্রতিষ্ঠান গত ১১ বছরের পরিশ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি ও তার স্বামী।

করোনার কারণে গত বছরের মার্চ মাসে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে জীবন চালাতে সেই স্কুলের গেটের মুখেই বাচ্চাদের প্লাস্টিকের খেলনার দোকান সাজিয়ে বসেছেন নুর আক্তার ডলি। করোনার আগে যে ফটক মুখর থাকত ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণে।

গত রোববার দুপুর ১২টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে কোনো ক্রেতা নেই। বিক্রেতার চেয়ারে অনেকটা বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন গ্রীন লিফ ইন্টারন্যাশলান স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক নুর আক্তার ডলি।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করতেই হতাশার সুরে ডলি বলেন, ‘সমাজের লাজলজ্জা ভুলে নিরুপায় হয়ে এই দোকান দিয়েছি। করোনার মধ্যে স্কুল চালাতে ৩০ লাখ টাকা ঋণ করেছি। প্রতি মাসে এক লাখ টাকা করে ঋণ বাড়ছে। মাথার উপর এই দেনা নিয়েই বেঁচে আছি। টাকার অভাবে ছেলেকে আর ভার্সিটিতে পড়াতে পারছি না। মেয়েরও লেখাপড়া বন্ধ। সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছি না।’

আদাবর এলাকার বায়তুল আমান হাউজিংয়ে ২০০৯ সালে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন নুর আক্তার ডলি ও তার স্বামী। করোনার আগে চারশর বেশি ছাত্র-ছাত্রী আর ২৬ জন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী নিয়ে বেশ ভালোই চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু করোনাঝড়ে ১৪ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে তাদের স্বপ্নের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

নিউজবাংলাকে নুর আক্তার ডলি জানান, স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেতন দিতে না পারায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। কেউ কেউ টিউশনি করে সংসার চালাচ্ছেন। স্কুলভবনে সপরিবারে বসবাস করছেন তিনজন শিক্ষক। তিনি নিজে পরিবার নিয়ে থাকছেন স্কুলসংলগ্ন একটি ভবনের ফ্ল্যাটে।

তিনি জানান, স্কুল বন্ধ থাকলেও জীবন তো আর থেমে থাকে না। তাই জীবন চালাতে এখন নিজের স্কুলের গেটের মুখেই বাচ্চাদের খেলনার দোকান সাজিয়ে বসেছেন।

স্কুলের গেটেই খেলনার দোকান দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক নুর আক্তার ডলি

ডলি বলেন, ‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৩য় সেমিস্টারে পড়ত।

‘টাকার অভাবে ফি দিতে পারি না, তাই তার পড়ালেখা এখন বন্ধ। মেয়েটা ছোট। ও আমার স্কুলেই পড়ত। স্কুল বন্ধ থাকায় তার পড়ালেখাও এখন বন্ধ। জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখছি। এমন পরিস্থিতিতে পড়ব সেটা আগে কখনো ভাবিনি। তবে আমার নিকট আত্মীয়রা একটু সাহায্য করছে বলে এখনো দুবেলা খেয়ে বেঁচে আছি।’

তিনি জানান, ভবনটির মাসিক ভাড়া ৭৫ হাজার টাকা। আর বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস বিল বাবদ মাসে আসে আরও ২৫ হাজার টাকা।

‘প্রতি মাসে আমাদের খরচ এক লাখ টাকা। বাড়িওয়ালা কিছুদিন হলো ভবন ভাড়া বাকি রাখতে রাজি হয়েছেন। স্কুল খুললে শোধ করে দেব। সব মিলিয়ে গত ১৪ মাসে আমাদের দেনা ৩০ লাখ টাকা। যেটা আত্মীয়স্বজনসহ অন্যান্য জায়গা থেকে ধার করেছি। আর প্রতি মাসেই ভবন ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ এক লাখ টাকার দেনা যোগ হচ্ছে’, বলেন তিনি।

এই প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, ‘বেতন দিতে পারি না, তাই এখানকার কিছু শিক্ষক গ্রামে চলে গেছেন। আর কিছু শিক্ষক আছেন। যারা আছেন তারাও তাদের বাড়িভাড়া দিতে পারেন না। তাই কয়েকজন শিক্ষক ও তাদের পরিবারসহ স্কুলের কয়েকটি কক্ষের আসবাব সরিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি।’

ডলি বলেন, ‘এখন যদি সরকার আমাদের স্কুল খুলে দেয় তাহলে বাঁচার একটু আশা থাকবে। না হলে সব শেষ হয়ে যাবে। আমরা তো কোনো প্রণোদনাও পাচ্ছি না।

‘কিছুদিন আগে শিক্ষা অফিস থেকে একজন এসেছিলেন। যখন জানলেন এটা এমপিওভুক্ত বা সরকারের তালিকাভুক্ত কোনো স্কুল না, তখন জানালেন আমরা সরকারের কোনো সাহায্য পাব না।’

খেলনার দোকান কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নারে ভাই, বেচাবিক্রি নাই। মানুষ এখন বেঁচে থাকার জন্য খাবার কেনে, খেলনা কেনে না। যেটুকু বিক্রি হয় সেটা দিয়ে কোনো রকমে পেট চলে। এভাবে আর কয়েক মাস চলতে পারব। তারপর সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব ভাবছি।’

নুর আক্তার ডলির মতো অবস্থা এখন আরও অনেক শিক্ষকের। তাদের দিন কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, সারা দেশে প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে এক কোটি ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। তাদের পড়াশোনা করাতেন ১০ লাখ শিক্ষক; যার মধ্যে ২০ শতাংশ স্থায়ীভাবে পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আর বাকি ৮০ শতাংশের অনেকে এখন সাময়িকভাবে অন্য পেশা গ্রহণ করে কোনো রকমে দিন পার করছেন।

এ বিভাগের আরো খবর