ব্যস্ত নাগরিক জীবন, প্রযুক্তিগত আসক্তি, উচ্চাকাঙ্ক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে অভিভাবকের সঙ্গে পরিবারের ছোট সদস্যদের দূরত্ব বাড়ছে। এর জের ধরে তৈরি হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছে।
পরিবারে শিথিল সম্পর্কের কারণ ও মানসিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের সঙ্গে; কথা হয়েছে অপরাধবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম মনে করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে পারিবারিক বন্ধন, নৈতিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, সন্তানের জন্য প্রথম রোল মডেল মা-বাবা। এই সম্পর্কে কোনো প্রকার ঘাটতি দেখা দিলেই সন্তান বিভ্রান্ত হতে পারে। সমবয়সী বন্ধুদের রোল মডেল হিসেবে ধরে তাদের মতো চলতে শুরু করে। আর বিপত্তিটা ঘটে তখনই।
মনোবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন একটা শিশু জন্ম নেয়, সাইকোলজির ভাষায় আমরা তাকে মানুষ বলি না, প্রাণী বলি। কারণ ওই সময় তার কোনো কিছু ভাবার ক্ষমতা বা স্মৃতি থাকে না। জন্মের পর শিশুদের ব্রেন থাকে পুরোপুরি ব্লাঙ্ক।
‘জন্মের পর দিনের পর দিন যা সে দেখবে, জানবে, শুনবে- সেসব দিয়েই তার মেমোরি তৈরি হবে। এগুলোর বেসিসে তার নীতিনৈতিকতা আর বুদ্ধি-বিবেচনা তৈরি হবে। আর এক্ষেত্রে জন্মক্ষণ থেকেই শিশু তার সামনে মডেল হিসেবে পায় মা-বাবাকেই।’
ড. মাহফুজা খানম মনে করেন, সামাজিকতার জায়গা থেকে নামমাত্র মা-বাবা না হয়ে প্রকৃত অর্থে মা-বাবার রোল বলতে যা বোঝায়, সেগুলো পালনের মাধ্যমে সন্তানকে নৈতিক আদর্শ ও বাস্তবমুখী শিক্ষা দেয়া গেলে সেই বাচ্চার বিকাশ স্বাভাবিক ও আশানুরূপ হবে।
তিনি বলেন, ‘সন্তান জন্ম দেয়ার পর মা-বাবা যদি শুধুই তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে তারা তাদের সন্তানের কাছে কী আদর্শ আশা করবেন? কারণ শিশুটির স্মৃতিতে মা-বাবার তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। তার মস্তিষ্কে আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষার বিষয়টিই কাজ করে না।’
বর্তমান সমাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা-বাবা তাদের সন্তানদের কাছে রোল মডেল হতে পারছেন না মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘আর সে জন্য অনেক সন্তানের মধ্যে তাদের মা-বাবাকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে দেখা যায় না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে না। আদর-স্নেহের অভাবে সন্তানও একটা সময় আর মা-বাবার কাছে মনের কথা খুলে বলার সাহস পায় না। এর ফলে মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে সন্তানের বিপথে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
‘আবার কিছু মা-বাবা আছেন, যারা তাদের সন্তানকে অতিরিক্ত শাসন বা অসুস্থ রুলসের মধ্য দিয়ে এমনভাবে গড়ে তোলেন যে তারা নিজেরাও বুঝতে পারেন না তাদের মধ্যে আসলে কী পরিমাণ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তারা সন্তানদের আত্মার আত্মীয় হতে পারেন না; বন্ধুও হতে পারেন না। নিজেদের অজান্তেই সন্তানের সঙ্গে গড়ে তোলেন সংকোচ, ভয়, লজ্জা নামের এক অভিভাবকের সম্পর্ক।’
ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যে বিরাট গ্যাপ তৈরি হয়ে আছে। বাচ্চাদের যতটুকু সময় দেয়ার কথা তার কানাকড়িও অনেক অভিভাবক দিতে পারেন না বা দিচ্ছেন না। সে তখন তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় কাটায়। এবং বন্ধুকেই সে রোল মডেল হিসেবে ধরে নেয়।
‘কারণ স্মৃতিতে তার মা-বাবার উপস্থিতি কম। যেহেতু বাচ্চাটা সমবয়সী বন্ধুকে রোল মডেল ভাবতে শুরু করছে, তখন তার চিন্তাভাবনা, বিচার-বিবেচনা স্বাভাবিক হবে- এমনটা ভাবা বোকামি। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকের সঙ্গে তার শেয়ারিং-কেয়ারিংয়ের মনোভাব থাকবে না সেটাও স্বাভাবিক।’
এই মনোবিজ্ঞানীর ধারণা, বাংলাদেশের অনেক পরিবারই এখন এই সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলন, ‘অবস্থা যখন এমন, তখন সমাজের বিরাট অংশের মানসিকতায় প্রভাব পড়বে সেটাও আমাদের মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। এমন প্রভাবের কারণে নানা অপ্রীতিকর, অস্বাভাবিক, ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটতেই থাকবে।
‘শুধু কি তাই? দেখবেন অনেক পরিবার বা অভিভাবক সব সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই গুরুত্ব দেয়। এ ক্ষেত্রে সন্তান তাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। হোক সেটা তারা যখন কর্মক্ষম, কিংবা সন্তান যখন কর্মক্ষম তখনও। টাকাটাই এখানে মুখ্য ভাবনা। সন্তান এত টাকা পাচ্ছে কোথায়? তার এমনভাবে চলাফেরা করাটা সঠিক কি না- এগুলো ভাবার সময় থাকে না তাদের।
‘অর্থাৎ কিছু অভিভাবক মনস্তাত্ত্বিকভাবে অসৎ হওয়ার কারণেই সন্তানরা আদর্শিক জায়গায় থাকতে পারে না। সুস্থ-সুন্দর চিন্তাও করতে পারে না। এই বাস্তবতা এখন পুরো সমাজের না হলেও সমাজের বড় একটি অংশের।’
ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘এসব অস্বাভাবিক বাস্তবতার কোনো একটা যখন সবার সামনে উঠে আসছে, তখন আমরা যার যার অবস্থান থেকে দোষারোপের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছি। এই প্রবণতা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি দেখা যাচ্ছে।
‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা আলোচনার মাধ্যমে- যেভাবেই হোক না কেন, এসব ঘটনার নগ্ন বিশ্লেষণ প্রতিনিয়ত যখন ছড়াচ্ছে, তখন সেগুলোর সঙ্গে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। মেনে নিচ্ছি এগুলো হওয়ারই ছিল। কিংবা পরিণতি যাই হোক, বাধ্য হচ্ছি মেনে নিতে। বলছি- ওমুক খারাপ, তমুক ভালো।’
অস্থির পরিস্থিতির জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম।
তিনি বলেন, ‘সর্বোপরি আমি বলব, আমাদের দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই মানুষের প্রতি মানুষের সহিংসতার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।’
সাদেকা হালিম বলেন, ‘আমরা দেখছি এখনকার সমাজের বেশির ভাগ ইয়াং জেনারেশন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়াটা কিন্তু খারাপ; আবার খারাপ না। খারাপ না এই অর্থে যে আমি আমার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন চাই। এই পরিবর্তনের জন্য স্টেপ বাই স্টেপ পার হয়ে উপরে উঠতে হয়। পড়াশোনা, পরিশ্রম, সাধনা, সততা এমন অনেক কিছু করতে হয়। কিন্তু এগুলো তো কষ্টসাধ্য।
‘বর্তমান সমাজের বেশির ভাগ ইয়াং স্বাভাবিক গতিতে জীবন বদলানোর কথা চিন্তা না করে শর্ট টাইমে, এমনকি রাতারাতি জীবন বদলানোর চিন্তা করে। এ ক্ষেত্রে চরিত্র বিসর্জন দিতেও অনেকের কাছে কোনো ব্যাপার না বলে মনে হয়। এটাই হলো খারাপ উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সত্যি বলতে, এমন ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা সব সময়ের জন্য বিকল্প রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু যারা তাদের ব্যবহার করছে- বা এমন অনিশ্চিত পথে নিয়ে আসছে তারা কিন্তু মেয়েগুলোর পরিবার থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। ব্যবসা-বাণিজ্য বলেন, রাজনীতি বলেন সব জায়গায় তাদের হাত আছে। এমন পরিস্থিতিতে যখন সহিংসতা হয় তখন সাধারণ মানুষ খুব অসহায় হয়ে পড়ে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান জিয়া রহমান মনে করেন, আমাদের দেশে বেশ আগে থেকে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে। কারণ সমাজে যেসব অপরাধ ঘটে বা ঘটছে সেসব অপরাধ কেন ঘটছে, যারা ঘটাচ্ছে তাদের মানসিকতা কেমন, তারা কোন সোসাইটি বা পরিবারে বিলং করছিল সেসব নিয়ে কোনো গবেষণা নেই।
এই কারণেই যারা অপরাধগুলোর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে বা ঘটনার ভিকটিম হচ্ছে, তাদের আত্মোপলব্ধি হয়নি বা হচ্ছে না। ফলে অপরাধ দিন দিন বাড়ছে।
তিনি বলেন, ‘গবেষণা না থাকার জন্যই আমরা কোনো সমাধানের পথে এগোতে পারছি না। কোনো ঘটনা ঘটলে দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধারণামূলক বা আন্দাজ করে একটা কিছু বলা হয়ে থাকে।’
জিয়া রহমান বলেন, ‘তাছাড়া মানুষের অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ার আরও কিছু বিষয় আছে। তার মধ্যে বড় একটি হলো কালচারাল গ্যাপ। অর্থাৎ আমরা যেসব সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি, আমাদের ইয়াং জেনারেশন কিন্তু সেসব থেকে বহু দূরে। সংস্কৃতির সংস্পর্শ যদি না পাওয়া যায় তাহলে সেই মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই অসুস্থ চিন্তার দিকে ঝুঁকবে।
‘আরেকটা বিষয় হলো, বর্তমানে বেশির ভাগ মানুষের টেনডেন্সি হলো শর্টকাটে নিজের অবস্থার উন্নতি করা। এটা তো আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া না। ফলে শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়ে অনেক সময় অপরাধের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে অনেকে।’