ঘর মিলেছে, তবে বেড়েছে ভোগান্তি। নেই বিদ্যুৎ, পানি ও স্যানিটেশন। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার পেয়ে খুশি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের লোকজন। কিন্তু গরিবের এ ঘর তৈরিতে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ মিলছে।
নির্দেশনা অনুযায়ী ময়মনসিংহে ৪ হাজার ৭০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ১৩ উপজেলায় ১ হাজার ৩০৫টি গৃহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে জেলায় ৬৪৫টি ঘর নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে।
এসব ঘর বানাতে নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। বারান্দা, পিলারসহ ঘরের বিভিন্ন অংশে ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে ফাটল। ফলে ঘর তৈরিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এ ছাড়া ঘরগুলোতে নেই বিদ্যুৎ, পানি ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা। ফলে ঘরে বসবাস করছেন না তালিকাভুক্ত অনেক অসহায়।
তারা নানা কারণে মুখ না খুললেও নান্দাইলের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন ঘর পরিদর্শনে গিয়ে কাজের মান দেখে নিজেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
নান্দাইল উপজেলার ৫ নম্বর গাঙ্গাইল ইউনিয়নের শিয়ালধরা বাজারের কাছে গিয়ে দেখা যায়, পাশের জমির উচ্চতায় পাঁচটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় নিচের দিকে ঝুলে গেছে কয়েকটি বারান্দা। এক ঘরের চাল অন্য চালের ওপর পড়েছে।
এ ছাড়া ৮ নম্বর সিংরইল ইউনিয়নের বোরাঘাটে ৯টি ঘর তৈরিতে নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। কোনোটির বারান্দা, পিলারে এরই মধ্যে ফাটল ধরেছে। ৯ নম্বর আচারগাঁও ইউনিয়নের চানপুর গ্রামে তৈরি করা ঘরগুলোতেও দেখা দিয়েছে বিভিন্ন স্থানে ফাটল। নলকূপ বসানো হয়নি বলে অন্যদের বাড়ি থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে। বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়নি। এসব সমস্যার কথা ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলো জানালেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি কেউ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন চিত্র শুধু নান্দাইলে নয়। ময়মনসিংহ সদরের চর দক্ষিণপড়া এলাকায় দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো হুমকির মুখে। কারণ, ঘরগুলোর একেবারে পাশেই নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে ব্রহ্মপুত্র নদের মাটি দেদার কাটছে অনেকে। এতে করে ঘরগুলোর পাশে কোথাও জমেছে পাহাড়সম মাটি, আবার কোথাও অসংখ্য বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মাটি কেটে ঘরের আরও কাছে এলেই হুমকিতে পড়তে পারে ঘরগুলো।
এ ছাড়া অন্যান্য উপজেলায় নির্মিত ঘরগুলোর কিছু অংশে ফাটল রয়েছে বলে জানা গেছে। নলকূপ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় বসবাস করছেন না তালিকাভুক্ত অনেক অসহায়।
ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুস্তাফিজুর রহমান শনিবার (২২ মে) দুপুর ১টায় নিউজবাংলাকে বলেন, উপজেলার ১২ নম্বর আমিরাবাড়ি ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৮টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এগুলোতে ছিল না বিদ্যুৎ, পানি ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা। তাই এসব অসহায় লোকজনের দুর্ভোগ লাঘবে ইতিমধ্যে তিনি এসব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার নান্দাইলের এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন নিজের ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন: ‘১০ নম্বর শেরপুর ইউনিয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীনদের যে ঘর দিয়েছেন, তা পরিদর্শনে যাই। যারা এই ঘরগুলো তদারকি করে বানিয়েছেন, তাদের অনেক গাফিলতি আছে। এখনও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা হয়নি। সম্পূর্ণ প্রশাসনিক তদারকিতে এই ঘরগুলো নির্মাণ হয়েছে। কোনো জনপ্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করা হয়নি এই নির্মাণকাজে, কিন্তু কেন? এখন এই নিম্নমানের নির্মাণকাজের দায় কে নিবে?’
এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান সমালোচনা শুরু হয়। অ্যাডভোকেট খলিলুর রহমান কমেন্ট করে লিখেছেন: ‘খুবই দুঃখজনক। কে কাকে অভারলুক করে পকেট ভারী করবে সে চিন্তাই যেন ব্যস্ত। তাতে আমাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ কেন পিছিয়ে থাকবেন, সুযোগ পেয়েছেন পকেট ভরেছেন। তাদের দায়বদ্ধতা নেই কিন্তু জনপ্রতিনিধি সম্পৃক্ত থাকলে আরও ভালো কিছু হতো বলে মনে হয়।’
আর জে মিন্টু নামে আরেকজন লিখেছেন: ‘মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নে দুটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা। ঘরের সামনে নেই মাটি, বৃষ্টি হলে পানি জমবে। বর্তমানে ঘরে থাকছে না কেউ। বিষয়টি দেখার জন্য অনুরোধ করছি।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে দুই শতক খাসজমি প্রদান করে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রতিটি আধা পাকা ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। পরিবহনে প্রতি ঘরের জন্য আরও ৪ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়েছে। টিনের চাল, দেয়াল ও মেঝে পাকা বাড়িগুলো সরকার নির্ধারিত নকশায় নির্মাণ করা হয়। বাড়িতে থাকছে রান্নাঘর, সংযুক্ত টয়লেট, ইউলিটি স্পেসসহ অন্যান্য সুবিধা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তালিকাভুক্ত গৃহহীনদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয় ঘরের চাবি। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে জেলায় ৬৪৫টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে সদরে ৭৫টি ঘর নির্মাণ চলছে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘অনেক স্থানে বিদ্যুৎ ও পানি না থাকার বিষয়টি সুরাহার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বলা হয়েছে। ঘরের ত্রুটি নিয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তথ্য অনুযায়ী সব তালিকাভুক্ত ব্যক্তি ঘরে উঠেছেন।’