অর্থের অভাবে দোকানঘর ভাড়া নিয়ে সেলুন করার সামর্থ্য নেই আবদুল বারিক ও জুলফিকারের। তারা টেম্পুর চার চাকার ওপর লোহার ফ্রেমে টিনের এক চালা দিয়ে বানিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ সেলুন।
গাইবান্ধার ফুলছড়ির বারিক ও জুলফিকারের ভ্রাম্যমাণ সেলুনে চুল-দাড়ি কাটাতে প্রতিদিন ভিড় করেন যুবক, শিশু ও বৃদ্ধরা। শহর-গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে মানুষের চুল-দাড়ি কাটছেন তারা। এমনকি ফোন করলে হোম সার্ভিসও দিয়ে থাকেন নরসুন্দর দুই ভাই। কম টাকায় সেবা পাওয়ায় স্থানীয় লোকজনের কাছে ভ্রাম্যমাণ সেলুনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের টনপাড়া গ্রামে ১৯ বছর ধরে ফুলছড়ির কেতকির হাটে দোকানঘর ভাড়া নিয়ে সেলুন চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। গেল বছর বন্যায় বাঁধ ভেঙে দোকানটি নদীগর্ভে বিলীন হয়।
তারা জানান, ওই দোকানে দিনরাত খেটে কোনোমতে সংসার চলাতেন। দোকান চলে যাওয়ার পর তাদের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। জামানত দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় সেলুন করার সামর্থ্য আর হয় না। পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন।
বন্যা আর নদী ভাঙনে কয়েক বছর আগে পৈতৃক ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হন তারা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বারিক শ্বশুরবাড়িতে আর জুলফিকারের আশ্রয় হয় অন্যের জমিতে। দুই ভাইয়ের উপার্জনের টাকায় জোগাতে হয় পরিবারের ১০ সদস্যের খাবার। পুঁজি বলতে কিছুই নেই।
একপর্যায় দুই ভাই একটি ভ্রাম্যমাণ সেলুন তৈরির উদ্যোগ নেন। পুরোনো চারটি টেম্পুর চাকার ওপর কাঠ-লোহার ফ্রেম বসিয়ে টিনের এক চালা দিয়ে বানান ঠেলাগাড়ি। সঙ্গে জুড়ে দেন একটি বড় রঙিন ছাতা।
ভ্রাম্যমাণ সেলুনের দুই পাশে দুইটি চেয়ার, মাঝখানে বসানো হয়েছে আয়না। আয়নার সামনে দুই পাশে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, ফিটকেরি, পাউডারসহ নানান সরঞ্জাম। সন্ধ্যা-রাতে আলোর জন্য বসানো হয়েছে একটি সৌরবিদ্যুৎ বাল্ব।
সেলুনটি বানাতে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। দেড় বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ সেলুন নিয়ে হাট-বাজার, গ্রামগঞ্জের মোড়ে ঘুরে খোলা আকাশের নিচে মানুষের চুল, দাড়ি কাটছেন তারা। কেউ ফোন করলে বাড়িতে গিয়ে হাজির হন।
তারা জানান, প্রতিদিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই ভাই সেলুনে কাজ করেন। যা আয় করেন তা দিয়েই পরিবার-পরিজন নিয়ে চলছে তাদের জীবন।
সেলুনে আসা লোকজন জানান, হাট-বাজার ও শহরের সেলুনে চুল-দাড়ি কাটলে ৫০ থেকে ৮০ টাকা দিতে হয়। হাতের কাছে ভ্রাম্যমাণ সেলুনে চুল-দাড়ি কাটানো যায় মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকায়। খোলামেলা পরিবেশ হলেও নরসুন্দর দুই ভাইয়ের অন্তরিকতায় চুল-দাড়ি কাটা ও সেবায় খুশি তারা।
স্থানীয় লাল মিয়া বলেন, ‘আগে তো গ্রামে গ্রামে ক্ষুর-কেঁচি নিয়ে নাপতেরা ঘুরি বেড়াছে। সেগলে তো এখন নাই। এখন এমারে ঠেলাগাড়ি দেখি খালি। এমাক ফোন করলে বাড়িতেও যায়। এটাই তো সুবিধা।’
গ্রামের আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘এমার খুব নাম-ডাক। কাম ভালো। ভালো ব্যবহার। টেকা কম নেয়। বাজারত চুল-দাড়ি কাটলে ৮০-৯০ টেকা নেয়। আর এমাক ২০ টেকা দিলেও নেয়। আপত্তি নাই।’
চুল কাটতে আসা এক ব্যক্তি বলেন, ‘ধুলে-বালি আসে। সেই রকম পরিবেশ এখনো হয় নাই। যদি ভালো পরিবেশ পায়; তাইলে চুল কাটা আরও উন্নত হবে আমাদের।’
নরসুন্দর জুলফিকার বলেন, ‘২০০১ সাল থাকি আমি এই কাজে জড়িত। এখন ভ্রাম্যমাণ সেলুনে চুল কাটতিছি। গ্রামে গ্রামে চুল কাটি আমার জীবনটা খুব কষ্টে কাটতিছে।
‘একটা দোকান হলি খুব সুন্দর হয়। মানুষের চুল-দাড়ি কাটি একটু সুন্দরভাবে ডাল-ভাত খাইতে পারতাম।’
আবদুল বারিক বলেন, ‘অভাবের কারণে এই কাজটা করি খাই। বাচ্চা-কোচ্চা বাঁচান নাগে। শারীরিক অবস্থাও আমার ভালো না; অন্য কামও করতি পারি না।
‘সরকার যদি আমাদের একটা ঠিকানা করি দিল হয়; বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকপের পালেম হয়। হামার তো টাকা নাই যে, ঘর দিমো।’
আবদুল বারি ও জুলফিকারের গড়ে তোলা ভ্রাম্যমাণ সেলুনের জনপ্রিয়তার কথা জানা আছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির। দুই ভাইয়ের জন্য একটি দোকানের ব্যবস্থা করাসহ তাদের স্থায়ী বসবাসে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লিটন মিয়া।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাসমান সেলুনটি যেকোনো জায়গায় কার্যক্রম চালাতে পারছে। এখানকার সাপ্তাহিক বাজারগুলোতেও তাদের সেলুন নিয়ে গিয়ে কাজ করে।
‘আমি চেয়ারম্যান হিসেবেও তাদের সহযোগিতা করব ঘর পাওয়ার জন্য। এ ছাড়া তাদের বাসস্থান ও দোকানঘর করতে সব ধরনের সহযোগিতা করব।’