দুই মাস আগেও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর খুব কম কর্মকর্তাই গাজায় উত্তপ্ত পরিস্থিতির কথা ভাবতে পেরেছিলেন। তারা বারবার বলে আসছিলেন, ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ১০০০ মাইল দূরের ইরান কিংবা উত্তর সীমান্তের ওপারের লেবানন। তবে এই কয়দিনের মধ্যে কিছু কিছু ঘটনা একসঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করেছে বিস্ফোরক পরিস্থিতি। ফিলিস্তিনের বর্তমান সহিংসতার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। বাংলায় প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
চলতি সপ্তাহে গাজা থেকে প্রথম রকেট ছোড়ার ২৭ দিন আগের ঘটনা। একদল ইসরায়েলি পুলিশ জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ঢুকে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে চুনাপাথর দিয়ে বানানো বিশাল চত্বরটির দিকে যায়। পুলিশের এই দলটি পুরনো চারটি মিনার থেকে আজান ও প্রার্থনা প্রচারে ব্যবহৃত লাউডস্পিকারের তারগুলো কেটে দেয়।
১৩ এপ্রিল অর্থাৎ মুসলিমদের জন্য পবিত্র রমজানের প্রথম রাতে এই ঘটনা ঘটে। দিনটি ইসরায়েলের জন্যেও বিশেষ, কারণ ওই দিন দেশের হয়ে যুদ্ধে শহিদদের স্মরণ করে তারা।
মসজিদের ঠিক নিচেই ইহুদিদের জন্য পবিত্র পশ্চিম দেয়ালে দিনটি উপলক্ষে ভাষণ দিচ্ছিলেন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট নেতা নিয়াহু। এ সময় উপরের মসজিদ থেকে প্রার্থনার ধ্বনিতে প্রেসিডেন্টের ভাষণ চাপা পড়ে যায় কিনা, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন ইসরায়েলি পুলিশ অফিসাররা।
পুরো ঘটনাটির সাক্ষ্য দেন মসজিদের চার কর্মকর্তা। তিনজন ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। ইসরায়েলি পুলিশ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি। বহির্বিশ্বে প্রায় কেউই ঘটনাটি নিয়ে কিছু জানতেন না।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনিদের চলমান সহিংসতার সূত্রপাত গত ১৩ এপ্রিল। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমসতবে ইসলামের অন্যতম পবিত্র মসজিদে ওই হামলা আরও বেশ কয়েকটি ঘটনার অন্যতম, যার জের ধরে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও গাজা উপত্যকা শাসনকারী হামাসের মধ্যে ফের যুদ্ধ ও ইসরায়েল জুড়ে আরব-ইহুদিদের মধ্যে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়।
‘এটাই টার্নিং পয়েন্ট ছিল। তাদের ওই পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে’, বলেন জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ একরিমা সাবরি।
কেউ কল্পনাই করতে পারেননি যে, পরিস্থিতির এত দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও বিধ্বংসী অবনতি ঘটবে। এর জের ধরে বহু বছরের মধ্যে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের ভয়াবহতম সহিংসতা ঘটেছে। এর মধ্যে গাজায় ১৪৫ জন ও ইসরায়েলে ১২ জন নিহত হওয়াই শুধু নয়, ইসরায়েলের আরব-ইহুদি অধ্যুষিত শহরের দাঙ্গাও অন্তর্ভুক্ত।
ইসরায়েল শাসিত পশ্চিম তীরের শহরগুলিতেও বিক্ষোভের কারণ ছিল এটি। শুক্রবার সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী ১১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। যার ফলস্বরূপ লেবাননের এক ফিলিস্তিনি শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ইসরায়েলের উদ্দেশে রকেট হামলা করা হয়। জর্ডানিয়ানরা ইসরায়েলের দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যায় ও স্বল্প সময়ের জন্য লেবানিজ বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির দক্ষিণ সীমান্ত অতিক্রম করে।
যে সময়টাতে ইসরায়েল সরকার টিকে থাকার সংগ্রাম করছে এবং তারা যাকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে দেখে সেই হামাস যখন ফিলিস্তিন আন্দোলনে নিজেদের ভূমিকা জোরদারের চেষ্টা করছে আর যখন নতুন ফিলিস্তিনি প্রজন্ম নিজস্ব মূল্যবোধ ও নতুন লক্ষ্য নিয়ে বেড়ে উঠছে তখনই শুরু হয় এই সংকট।
একে গাজায় কয়েক বছর ধরে চলমান অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা, পশ্চিম তীরে কয়েক দশকের দখল ও ইসরায়েলে বসবাসকারী আরবদের বিরুদ্ধে কয়েক দশকের বৈষম্যের পরিণাম হিসেবে দেখছেন ইসরায়েল পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার ও ওয়ার্ল্ড জিওনিস্ট অরগানাইজেশনের সাবেক সভাপতি আভ্রাহাম বার্গ।
তিনি বলেন, ‘সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম জায়গামতোই ছিল। শুধু একটা ট্রিগারের দরকার ছিল। আর সেই ট্রিগারটা হলো আল আকসা মসজিদ।’
হামাসের সঙ্গে শেষ বড় সংঘাতের পর সাত বছর ও শেষ বড় ফিলিস্তিনি আন্দোলন- ইন্তিফাদার পর ১৬ বছর পার হয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যখন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নিলেন, তখনও সেখানে বড় কোনো বিক্ষোভ হয়নি।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলো সন্ধি করবে না এমন ধারণা ত্যাগ করে যখন চার আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করে ফেলে তখনও সেখানে কোনো গণবিক্ষোভ বা প্রতিবাদ হয়নি।
দুই মাস আগেও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর খুব কম কর্মকর্তাই এমনটা ভাবতে পেরেছিলেন। সামরিক বাহিনীর কর্তারা বারবার বলে আসছিলেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ১০০০ মাইল দূরের ইরান কিংবা উত্তর সীমান্তের ওপারের লেবানন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ বিদেশী কূটনীতিক বলেন, মার্চ মাসে যখন কূটনীতিকেরা গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক প্রশাসনের দুই জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক করেন, তখন তারা ওই দুইজনকে বড় কোনো সহিংসতার সম্ভাবনা সম্পর্কে নিরুদ্বিগ্ন থাকতে ও তুলনামূলকভাবে লম্বা শান্তির সময় নিয়ে স্বস্তিতে থাকতে দেখেছেন।
গাজা করোনাভাইরাস সংক্রমণ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল। হামাসসহ ফিলিস্তিনের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ছিল ১৫ বছর পর মার্চের ফিলিস্তিনি নির্বাচনের অপেক্ষায়। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজায় বেকারত্বের হার প্রায় ৫০ শতাংশ। ফিলিস্তিনিরা যে কারণে যুদ্ধের চেয়ে অর্থনীতির উপর জোর দেয়ার দাবি জানাচ্ছিল, আর কমছিল হামাসের জনপ্রিয়তা।
তবে এপ্রিলে বদলাতে শুরু করে মনোভাব। রমজানের প্রথম রাতে ১৩ এপ্রিল আল আকসায় নামাজ পড়ছিলেন মুসলিমরা আর একই সময় কাছেই ভাষণ দিচ্ছিলেন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট রউভেন রিভলিন।
মসজিদের এক কর্মকর্তা বলেন, জর্ডান সরকার নিয়ন্ত্রিত মসজিদের পরিচালনা পর্ষদ ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের ভাষণ চলার সময় প্রার্থনা প্রচার না করতে ইসরায়েলের অনুরোধকে অসম্মানজনক বিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করে।
যে কারণে ওই রাতে মসজিদে অভিযান চালায় পুলিশ ও স্পিকারগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
শেখ সাবরি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই। এটা একেবারে স্পষ্ট যে ইসরায়েলি পুলিশ আকসা মসজিদ ও পবিত্র রমজান মাসকে অপমান করতে চেয়েছে।’
এ অভিযোগের বিষয়ে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দাবি করেন, স্পিকারগুলো বন্ধ করা হয়নি। পরে অবশ্য তারা জানায়, বিষয়টি ফের যাচাই করে দেখা হবে।
অন্য কোনো বছর হলে পুরো ঘটনাটি সবাই খুব দ্রুত ভুলে যেত। কিন্তু গত মাসে হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিতভাবে বেশ কয়েকটি ঘটনা একই সঙ্গে ঘটে যা এই ছোট বিষয়টিকে একটি বড় সংকটে পরিণত করে।
আল-আকসায় একাধিক অভিযান প্রতিহত করাই শুধু নয়, ছয় ফিলিস্তিনি পরিবারকে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদের মাধ্যমে তরুণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের পুনর্জাগরণ ঘটে।
কট্টর ডানপন্থিদের আশ্বস্ত রাখার উদ্দেশ্য থেকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পরিস্থিতি শান্ত করতে খুব বেশি উৎসাহ দেখাননি।
ফিলিস্তিনে সৃষ্ট আকস্মিক রাজনৈতিক শূন্যতা ও তৃণমূলের প্রতিবাদ হামাসকে তার শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয়।
ফিলিস্তিনে এই পরিবর্তনগুলো ইসরায়েলের অজান্তেই ঘটছিল। এক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের সমতা ও রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবির সমাধান নয়, বরং নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো সমস্যা হিসেবে দেখতে থাকা কট্টর ডানপন্থি সরকারের কারণে কিছুটা আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের সাবেক পরিচালক আমি আয়ালন বলেন, ‘আমাদের জেগে উঠতে হবে। বর্তমান অবস্থা যে স্থিতিশীল সে ধারণা থেকে শুরু করে আমরা যেভাবে সবকিছুকে দেখি সেটা বদলাতে হবে।’
লাউডস্পিকারের ওই ঘটনার পরপরই ওল্ড সিটি অফ জেরুজালেমে ঢোকার অন্যতম পথ এবং অন্যতম জনপ্রিয় একটি চত্বর দামাস্কাস গেট বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। রমজানের রাতে তরুণ ফিলিস্তিনিরা সাধারণ সেখানে জমায়েত হন।
পুলিশের মুখপাত্র মিকি রোসেনফেল্ড জানান, বিপজ্জনক ভিড় ও কোনো ধরনের সহিংসতা এড়াতেই চত্বরটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
ফিলিস্তিনিদের জন্য এটা ছিল আরেকটা অপমান। যার কারণে শুরু হয় প্রতিবাদ। প্রতিরাতেই জায়গাটির দখল নেয়ার জন্য পুলিশ ও তরুণদের সংঘর্ষ হতে থাকে।
পুলিশের ভাষ্য, প্রতিবাদকারীরা বিশৃংখলা তৈরি করেন, যে কারণে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার ছিল। কিন্তু অনেক ফিলিস্তিনির কাছে চত্বর থেকে সরিয়ে দেয়াটা ছিল একটি ছোট ঘটনা, যার অন্তরালে লুকিয়ে আছে আরও গভীর দুঃখদুর্দশা।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় দখল হওয়া ও পরে ইসরায়েলে সংযুক্ত পূর্ব জেরুজালেমের বেশিরভাগ বাসিন্দা ফিলিস্তিনি, নিজের ইচ্ছাতে তারা ইসরায়েলি নাগরিক নন। অনেকে মনে করেন, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলে দখলদারদের বৈধতা দেয়া হবে। এ কারণে তারা ভোট দেন না।
অনেকের মতে, তাদের ধীরে ধীরে জেরুজালেম থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। বিল্ডিং পারমিট নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, যে কারণে অধিবাসীদের হয় শহর ছাড়তে হচ্ছে, নয়ত অবৈধ বসতি স্থাপন করতে হচ্ছে; যেগুলো যেকোনো সময় সরকার উচ্ছেদ করে দিতে পারে।
পুরো সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি চত্বর থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটি তাদের সবসময় বৈষম্যের শিকার হওয়ার অনুভূতিকে আরও প্রবল করে তোলে।
পূর্ব জেরুজালেমের ২৭ বছর বয়সী কসাই মাজেদ আল কেইমারি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, তারা শহর থেকে আমাদের উপস্থিতি মুছে ফেলতে চাইছে। তাদের সামনে প্রতিবাদ করা ও নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়া জরুরি ছিল আমাদের জন্য।’
দামাস্কাস গেটে সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় দ্রুত। ওই সপ্তাহে ঘটনার কয়েকদিন পর ফিলিস্তিনি তরুণেরা ইহুদিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। অনেকেই ভিডিও করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া সাইট টিকটকে পোস্ট করেন। এরপরই ইহুদিদের সংঘবদ্ধ প্রতিশোধ শুরু হয়।
পুলিশি অভিযানের এক সপ্তাহ পর, ২১ এপ্রিল চরম ডানপন্থি ইহুদি সংগঠন লেহাভার কয়েক শ সদস্য জেরুজালেমের কেন্দ্রে মিছিল বের করে। তারা ‘আরবদের মৃত্যু হোক’ স্লোগান দিতে দিতে ফিলিস্তিনি পথচারীদের আক্রমণ করে। এক ভিডিওতে দেখা যায় একদল ইহুদি ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ও আরেক দল ফিলিস্তিনি ভেবে গাড়ি চালকদের মারধর করছে।
বিদেশি কূটনীতিক ও সম্প্রদায়ের নেতারা দামাস্কাস গেটের বাইরে চত্বরটি খুলে দিয়ে জেরুজালেমের উত্তপ্ত পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, দেশটির সরকার পুরো বিষয়টিতে অনাগ্রহ দেখায় ও তাদের মনোযোগও সেদিকে ছিল না।
নেতানিয়াহু মার্চের নির্বাচনের পর জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। দুই বছরের মধ্যে এটি ছিল চতুর্থ নির্বাচন, যেটাতে কোনো সুস্পষ্ট বিজয়ী পাওয়া যায়নি। জোট গঠনের জন্য তার চরম ডানপন্থি কয়েকজন আইনজীবীকে রাজি করানো দরকার ছিল।
এদের একজন হলেন, ইতামার বেন জিভির। লেহাভার এই সাবেক আইনজীবী ইসরায়েলের প্রতি আনুগত্য নেই এমন আরব নাগরিকদের দেশ থেকে বের করে দেয়ার পক্ষে সরব প্রচার চালিয়েছেন। তিনি ১৯৯৪ সালে হেব্রনে ২৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা ইহুদি মৌলবাদী বারুচ গোল্ডস্টাইনের ভক্ত ও কিছুদিন আগেও তার শয়নকক্ষে বারুচের ছবি ঝুলত।
বেন জিভিরের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে কূটপরামর্শ ও জেরুজালেমে উত্তেজনা বাড়তে দেয়ার মাধ্যমে সংঘাত সৃষ্টি করে ইসরায়েলিদের তার নেতৃত্বের অধীনে রাখার অভিযোগ আছে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে।
প্রধানমন্ত্রীর জীবনী লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনশেল ফেফার বলেন, ‘ইহুদি ও আরবদের মধ্যে উত্তেজনা নেতানিয়াহু তৈরি করেননি। ইসরায়েল গঠনের আগে থেকেই তারা এখানে আছেন। তার দীর্ঘ শাসনামলে বারবার তিনি এই উত্তেজনাকে ইন্ধন দিয়েছেন ও নিজের সুবিধার জন্য কাজে লাগিয়েছেন। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তখন নেতা হিসেবে তা সামাল দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।’
নেতানিয়াহুর জ্যেষ্ঠ পরামর্শক মার্ক রেগেভ অবশ্য এই বিশ্লেষণকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। রেগেভ বলেন, ‘এর উল্টোটাই সত্য। শান্তি টিকিয়ে রাখতে উনি (নেতানিয়াহু) সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছেন।’
২৫ এপ্রিল ফিলিস্তিনিদের দামাস্কাস গেটের বাইরে জড়ো হতে দেয়ার বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয় ইসরায়েলি সরকার। তবে পরবর্তী কিছু ঘটনায় পুরো পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে।
এর প্রথমটি হল পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি এলাকা শেখ জাররা থেকে ছয়টি পরিবারকে উচ্ছেদ। মে মাসের প্রথম ভাগে তাদের মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারিত থাকলেও এপ্রিল জুড়ে নিয়মিত প্রতিবাদ ও মিছিল হতে থাকে। বসবাসকারীদের দুর্দশা ও দামাস্কাস গেটের ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পান ফিলিস্তিনিরা। যার ফলে প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়।
শেখ জাররায় নিজ বাড়িতে পুলিশি হামলায় পা ভেঙে যাওয়া স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের নেতা সাহাল দিয়াব বলেন, ‘আপনারা এখন শেখ জাররাহ, আল আকসা কিংবা দামাস্কাস গেটে যা দেখছেন এসব কিছুর উদ্দেশ্য আমাদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করা। আমার এলাকার ঘটনাটি এর শুরু মাত্র।’
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা শেখ জাররায় বিক্ষোভকারীদের উগ্রতা থামাতে গিয়েছিল। কিন্তু ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায় পুলিশ নিজেই সেখানে আক্রমণ করছে। পুলিশি আগ্রাসনের ছবিগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে যাওয়ার পর এলাকাটি ইসরায়েল, দখলকৃত অঞ্চল ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল গঠিত হওয়ার পর উচ্ছেদ পরিবারগুলোর ফের উচ্ছেদ হওয়ার অভিজ্ঞতাকে লেবাননে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি কবি জেহান বিসেইসো বর্ণনা করেছেন ‘নানা দেশে বাস করা প্রতিটি ফিলিস্তিনির কাছে এটি নিজের অভিজ্ঞতা’ হিসেবে।
এ থেকে আইনি বৈষম্যের একটি উদাহরণ সামনে আসে: ইসরায়েলি আইনে আছে ১৯৪৮ সালের আগে পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদিদের মালিকানাধীন জমি ইহুদিরা ফের দাবি করতে পারবেন। কিন্তু ওই বছর যে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে তাদের বংশধরদের পরিবারিক জমি দাবি করার কোনো আইনি উপায় নেই।
বিসেইসো বলেন, ‘মানুষকে তাদের ঘর থেকে উচ্ছেদ করতে দেখার মধ্যে একটা চক্রাকার ও উস্কানিমূলক বিষয় আছে। লক্ষ মাইল দূরে থাকলেও বিষয়টা খুবই উস্কানিমূলক ও সম্পর্কিত।’
লজ্জাজনক হারের ভয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ২৯ এপ্রিল নির্বাচন বাতিল করে দেন। এতে তার দূর্বলতা প্রকাশ পায়। এই পরিস্থিকে হামাস সুযোগ হিসেবে নেয় ও জেরুজালেমের রক্ষাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।
গাজা শহরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এমখাইমার আবুসাদা বলেন, ‘এর মাধ্যমে হামাস নিজেদের ফিলিস্তিনের জন্য যোগ্যতর নেতৃত্ব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে।’