বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

থেমে যেতে চায় মাস্টার মাখনের সাইকেলের চাকা

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ৯ মে, ২০২১ ১২:১৮

সাইকেলে চেপে দেশের পথে-প্রান্তরে শান্তির বাণী প্রচার করে জীবনের বড় সময়টাই পার করেছেন আব্দুল খালেক। শেষ দিনগুলোও তা-ই করে যেতে চান।

অদ্ভুত এক খেয়ালে জীবন পার করে দিয়েছেন মাস্টার মাখন। ১৯৮৩ সালের ২৫ জুলাই দিনাজপুরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি ২৫ বছরের তরতাজা যুবক। সাইকেল চালিয়ে মানুষের মাঝে শান্তির বাণী পৌঁছানোর এই নেশা সেই যে শুরু আর থামেনি।

মাস্টার মাখন, যার পুরো নাম শেখ মো. আব্দুল খালেক এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কিন্তু ক্লান্তি নেই এই মানুষটির। এখনও তিনি সাইকেল নিয়ে বেরোতে চান, পারেন না। বয়স একমাত্র কারণ নয়। এই বয়সে একটা জীবিকারও সংস্থান খুঁজতে হচ্ছে তাকে।

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের রূপনগর এলাকায় জন্ম আব্দুল খালেকের। ১৯৭৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তবে নানা কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি।

বাবা খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের অফিসে হেড ক্লার্ক ছিলেন। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় চাকরি করেছেন। সেই সুবাদে বাবার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকার সুযোগ হয়েছে আব্দুল খালেকের।

ছোটবেলা থেকে মনে প্রবল ইচ্ছে ছিল মানুষের কল্যাণে কিছু করার। সারা দেশে সাইকেল চালিয়ে সচেতনতামূলক শান্তির বাণী পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নেন তিনি। এখনও তা থামেনি। বয়সের ভারে আর সংসারে অনটনে আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে নেই মাস্টার মাখন।

ময়মনসিংহের আকুয়া মোড়লবাড়ি এলাকার একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকছেন ‘মাস্টার মাখন’। স্ত্রী, তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে বহু বছর ধরে এখানেই বসবাস। বড় ছেলে শেখ নাজমুল হুদা নাসিম (মিশন) তার বাবার এই কাজকে পছন্দ করেন। তিনিও বাবার শান্তির বাণী পৌঁছে দিচ্ছেন একটু অন্যভাবে। তিনি শহরের বিভিন্ন নোংরা দেয়াল পরিষ্কার করে লিখে রাখেন সচেতনতামূলক বাণী।

মাস্টার মাখনের ছোট ছেলে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। করোনার মহামারিতে চাকরি চলে গিয়ে এখন বেকার। সবার ছোট ছেলের বয়স এখন ১৫ বছর। সে-ও কোনো কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা চালাচ্ছে। একমাত্র মেয়ে বিয়ে করে ঢাকায় আছেন।

বয়সের ভারে সাইকেল চালাতে কষ্ট হয় মাস্টার মাখনের। ময়মনসিংহ শহরের জয়নুল আবেদিন পার্ক, স্টেশন রোডসহ বিভিন্ন এলাকার অব্যবহৃত জায়গায় পর্দার ছাউনি ও ছোট বেঞ্চ পেতে চায়ের দোকান করেন। তার পায়েস দিয়ে তৈরি চায়ের স্বাদটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চা বানানোর কাজটি করেন বড় ছেলে মিশন। কেউ চা খেতে এলে মাস্টার মাখন প্রচার করেন শান্তির বাণী।

১৯৭৯ সালে ময়মনসিংহের আকুয়া মোড়লবাড়ি এলাকায় (সিও অফিসসংলগ্ন) মাস্টার মাখনসহ তার পাঁচ ভাই একটি জর্দার কারখানা দিয়েছিলেন। তখনকার সময়ে জমজমাট ব্যবসা ছিল। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একেকজন একেক দায়িত্ব পালন করতেন। আব্দুল খালেক ওরফে মাস্টার মাখন ছিলেন বিপণনের দায়িত্বে।

এই ব্যস্ততার মাঝেও সাইকেল চালিয়ে মাঝেমধ্যেই রাস্তাঘাটে সচেতনতামূলক লেখা নিয়ে প্রচারে নামতেন তিনি। এ কাজটি তিনি হৃদয় দিয়ে করতেন।

জর্দার ব্যবসা বড় করতে ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়। কিন্তু একসময় তাদের জর্দার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। এদিকে পাওনাদাররাও ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে। এ অবস্থায় ২০০২ সালে ময়মনসিংহে তাদের নিজস্ব বাড়িসহ কারখানা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করে পরিবারটি।

মাস্টার মাখন তখন ঢাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু সাইকেলে সচেতনতামূলক বাণী প্রচার তখনও বন্ধ হয়নি। বেরিয়ে পড়েছেন পথে-প্রান্তরে।

মাখন মাস্টারের জনসচেতনতামূলক প্রচারণার বাণীগুলো হচ্ছে: নেশা ছাড়ুন সুস্থ থাকুন, শিরক হিংসা মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকুন, বিশ্ব মানবিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন, জিহ্বা ও লজ্জাস্থান হেফাজত করুন, দেহ-মন পবিত্র ও প্রফুল্ল রাখুন, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন, দুনিয়া ও অনন্তকালের প্রশান্তি লাভ করুন, মানুষ মরতে পারে কিন্তু নীতি আদর্শ কখনো মরে না, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মসজিদে মোবাইল বন্ধ রাখুন, গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল বন্ধ রাখুন, সহি-শুদ্ধ নামাজ বেহেশতের চাবি, অতিরিক্ত কথা বলা মিথ্যার শামিল, জনসমক্ষে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন, হাঁচি-কাশি ও শিষ্টাচার মেনে চলুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, প্রাণঘাতী করোনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকুন ইত্যাদি।

ময়মনসিংহ শহরের জয়নুল আবেদিন পার্কের (ব্যাট-বল) মোড়ের সঙ্গে পরিত্যক্ত জায়গায় সপ্তাহে কয়েক দিন পায়েস চা বিক্রি করেন মাস্টার মাখন আর তার বড় ছেলে।

চা স্টলের পেছনের দেয়ালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সচেতনতার বাণী লিখে রাখা হয়েছে। ভালোবাসার সেই সাইকেলটা সব সময় সঙ্গেই রাখেন মাস্টার মাখন। সাইকেলে বহন করা সচেতনতামূলক লেখা যে কেউ দেখে আকৃষ্ট হয়ে পড়তে শুরু করে।

৭ মে বিকেল ৪টার দিকে সেই পায়েস চা স্টলে গিয়ে দেখা যায়, পবিত্র রমজান মাসের জন্য চা বানানো বন্ধ। মাখন মাস্টার সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার ছেলে মিশন আর সহযোগী উজ্জ্বল সরকার কথা বলছেন। উজ্জ্বলও মাস্টার মাখনের ভক্ত। সারা দিন চা বিক্রি করে যা লাভ হয়, তার একটি অংশ উজ্জ্বলকে দিয়ে বাকি টাকায় কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

এখানে কথা হয় মাস্টার মাখনের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৮৩ সালে দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসককে বলেছিলাম, আমি সারা দেশে শান্তির বাণী প্রচার করার উদ্যোগ নিয়েছি। তখন তিনি খুশি হয়ে আমাকে সরকারি ডাকবাংলোয় থাকাখাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তখন নিজেকে নিয়ে গর্ব করতাম। কারণ, মানুষের কল্যাণে এমন কাজ সবাই করতে পারে না।

‘দিনাজপুরে সাইকেলে বিভিন্ন সচেতনতামূলক শান্তির বাণী কাগজে লিখে সাইকেল চালিয়েছি। দিনাজপুর শেষ করে রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রচার করে ময়মনসিংহে চলে আসি।’

ওই সময় তিনি যে জেলাতেই পা রেখেছেন, সেখানেই জেলা প্রশাসক সরকারি ডাকবাংলাতে থাকাখাওয়ার সুবিধা দিয়েছেন। এতেই তার মনে তৃপ্তি ছিল।

মাস্টার মাখন বলেন, ‘সাইকেল চালিয়ে শান্তির বাণী প্রচার করে সংসার চালানো যায় না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। ফলে মাঝেমধ্যে চাকরি করেছি ঢাকায় বিভিন্ন কোম্পানিতে। গত বছর ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সিকিউরিটি সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করার সময় আমার শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয়। তখন আমি ময়মনসিংহের নিজ বাড়িতে চলে আসি। শরীর সুস্থ হলে কোম্পানি আর আমাকে চাকরিতে নেয়নি। এরপর থেকে দিনগুলো আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে।’

মাস্টার মাখন আরও বলেন, ‘আমি সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে ভিড় করে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা আমাকে বেশি পছন্দ করে। আমার সচেতনতামূলক লেখাগুলো সকলের পরিচিত বাণী হলেও খুব আগ্রহ প্রকাশ করেই অনেকে পড়ে। এতে মনে তৃপ্তি পাই।

‘তবে সংসারে অভাবের কারণে আগের মতো আর দৌড়াতে পারি না। বড় ছেলেকে নিয়ে একটি অস্থায়ী চায়ের দোকান দিয়েছি। চা বিক্রি করে যে টাকা পাচ্ছি তা দিয়ে সংসার চলছে না।’

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখন তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তা চাই। মানুষের কল্যাণে পথে-প্রান্তরে সাইকেল নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে দৌড়েছি। ভিক্ষা করে নয়, সৎ পথে কর্ম করেই খেতে চাই। আমি একটি খাবারের হোটেল দিতে চাই৷ আর সেখানে লোকে যাতে মাত্র ৫০ টাকায় মাংসসহ পেট ভরে খাবার খেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে চাই। এ ছাড়া আমার চিকিৎসার জন্য সামান্য কিছু টাকার প্রয়োজন। সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকার সহায়তা পেলে আরও প্রচুর সচেতনামূলক বাণী কিনে প্রচার করব। কিছু টাকা দিয়ে নিজের চিকিৎসা করব এবং বাকি টাকা দিয়ে ভালো খাবারের হোটেল দিব।’

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, খোঁজখবর নিয়ে মাস্টার মাখনকে সহায়তা করা হবে।

এ বিভাগের আরো খবর