বরগুনা সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ওলিউল ইসলামের বিরুদ্ধে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সদর উপজেলার ২০টি কালভার্ট নির্মাণকাজে দুই ধাপে তিনি ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অভিযোগ।
ঘুষ নিয়েও বিল দেয়ায় গড়িমসি করায় গত সোমবার ঠিকাদাররা প্রায় তিন ঘণ্টা পিআইও ওলিউল ইসলামকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে তিনি অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হন।
ঠিকাদাররা জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় বরগুনা সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০টি কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের কাজ হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে লটারির মাধ্যমে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেয়া হয়। জুন-জুলাই মাসে কালভার্ট নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
সে সময় আমতলী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মফিজুর রহমান বরগুনা সদরের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। অসুস্থতার কারণে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে মফিজুর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে বেতাগী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওলিউল ইসলামকে বরগুনা সদরের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।
খালেক এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘মফিজুর রহমান দায়িত্বে থাকাকালীন ২০টি কালভার্টের কাজের মোট ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার বিলের বিপরীতে তিন ধাপে আমাদের ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। ওলিউল ইসলাম যোগদানের পর ঠিকাদাররা বাকি বিলের জন্য কয়েক দফা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু পিআইও ওলিউল বিল পাইয়ে দেয়ার জন্য আমাদের কাছে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন।’
রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘কাজ শেষ হওয়ার দেড় বছরের বেশি সময় আমরা বিলের জন্য অপেক্ষা করি। নিরুপায় হয়ে আমরা ২০টি কাজের ২০ ঠিকাদার বৈঠক করে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে সম্মত হই। টাকা নিয়ে ঢাকায় যোগাযোগ করতে বলেন পিআইও ওলিউল ইসলাম।
‘জানুয়ারি মাসে আমরা চারজন ঠিকাদার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের সামনে গিয়ে ওলিউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন ও অধিদপ্তরের ডিপিডি আলতাফ হোসেনের পিওন তাহের মিয়ার কাছে টাকা দিতে বলেন। আমরা ওলিউল ইসলামের উপস্থিতিতে তাহেরের কাছে টাকা দিয়ে দিই। তাহের ওই টাকা ওলিউল ইসলামের বাসায় পৌছে দেন।’
এ বিষয়ে মুঠোফোনে তাহের মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বর্তমানে বগুড়া সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে আছেন। বরগুনা সদরের পিআইও ওলিউল ইসলামকে দেয়া ঘুষের টাকা গ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পিআইও ওলিউল ইসলাম আমার পরিচিত, তবে তার বাবদ আমি বরগুনার ঠিকাদারদের কাছ থেকে ঘুষের কোনো টাকাপয়সা গ্রহণ করিনি।’
ওই কাজের অপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাঁই এন্টারপ্রাইজের লিটন শরীফ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ দুই বছর বিলের জন্য অপেক্ষা করছি। ধারদেনা করে ওলিউল ইসলামকে ঘুষ দিয়েও তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করছি। একই কাজে বরগুনার অন্য সব উপজেলার বিল পরিশোধ হয়েছে। এমনকি জামানতের টাকাও তুলে নিয়েছেন অনেকে। বরগুনা সদরের দায়িত্বে থাকা পিআইও ওলিউল ইসলাম ঘুষ নেয়ার পরও আমাদের বিল পরিশোধে গড়মসি করছেন।
‘তিনি দায়িত্বে থাকলেও বরগুনায় অফিস করেন না। আমরা ফোনে কল করায় তিনি আমাদের অনেকের নম্বর ব্লাক লিস্টেড করে রেখেছেন। সোমবার তিনি বরগুনা কার্যালয়ে এসেছেন এমন খবর পেয়ে আমরা গিয়ে তার কাছে বিলের টাকা চাই। কিন্তু তিনি ফের গড়মসি শুরু করেন। খবর পেয়ে অন্য ঠিকাদাররাও কার্যালয়ে এসে বিলের দাবিতে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে।’
জায়েদা এন্টারপ্রাইজ নামে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বাবু জোমাদ্দার বলেন, ‘ঠিকাদারি কাজে এসে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা দেখেছি। কিন্তু ওলিউল এমনই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, যে টাকা ছাড়া এক পাও নড়েন না। কাজের ধাপে ধাপে তাকে ঘুষ দিতে হয়। এরপরও চূড়ান্ত বিল পরিশোধে ঘুষ দাবি করেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আমরা তাকে ঘুষ দিয়েছি। কিন্ত তিনি বিল নিয়ে ঘোরাচ্ছেন।’
ঠিকাদারদের এসব অভিযোগের বিষয়ে ওলিউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘুষ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। ওলিউল বলেন, ‘প্রকল্পের কাজের সময় মফিজুর রহমান দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বদলি হওয়ার কারণে কাগজপত্রের বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আমি নতুন করে কাজের কাগজপত্র গুছিয়ে হেড অফিসে পাঠিয়েছি। হেড অফিস থেকে টাকা দিলেই আমি তাদের টাকা শোধ করে দেব।’
তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সে প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এক পয়সাও ঘুষ নিইনি, এসব অভিযোগ মিথ্যা।’
বিলের আগেই জামানত ফেরত
ঠিকাদারদের তোপের মুখে বুধবার পিআইও ওলিউল ইসলাম কাজের চূড়ান্ত বিল প্রদানের আগেই জামানাতের টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে ঠিকাদাররা জানিয়েছেন।
খালেক এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার রিয়াজ হোসেন বলেন, ‘ঘুষের অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার জন্য পিআইও ওলিউল ইসলাম আমাদের ডেকে জামানতের টাকা ফেরত দিয়েছেন।’
রিয়াজ হোসেন বলেন, ‘আমার ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জামানত ফেরত দিয়েছেন।’ ঠিক একইভাবে ওই প্রকল্পের ২০টি কালভার্টের কাজের ঠিকাদারদের সবার টাকাই ফেরত দেয়া হয়েছে বলে রিয়াজ জানান।
বিলের আগে জামানত ফেরত দেয়ার প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পিআইও ওলিউল ইসলাম বলেন, ‘বিল নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কাজের বিপরীতে চূড়ান্ত বিল প্রদানের প্রতিবেদন পেয়েছি। সে কারণে ঠিাকাদারদের জামানত ফেরত দেয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার ঘুষ নেয়ার ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।