মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার টিনের ঘরটি ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখন সেটি জীর্ণশীর্ণ। জং ধরা টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে।
আর এই ঘরের মালিক নুরুল ইসলাম বয়সের ভারে ন্যুব্জ। নব্বই ছুঁইছুঁই। একসময় ছিলেন ধনী। প্রায় ৩০ বিঘা জমি ছিল তার। সেই জমির অনেকটা অংশ দান করেন স্থানীয় উত্তর মরুয়াদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। বাদবাকি জমি বিক্রি করে দেন। এখন ৫ শতাংশ ভিটাবাড়ি ছাড়া সহায়সম্বল বলতে কিছু নেই।
অথচ তার আজও জোটেনি বয়স্ক ভাতার কার্ড। না পেয়েছেন সরকারি একটি ঘর, না কোনো সহায়তা। এখন তার দিন কাটে অর্ধাহারে, অনাহারে, আটা-চিড়া খেয়ে।
নুরুল ইসলামের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের উত্তর মরুয়াদহ গ্রামে।
নুরুল তার স্ত্রী মজিরন বেগম ও পাঁচ বছর বয়সী নাতি রোম্মান মিয়াকে নিয়ে থাকেন ওই ভাঙা ঘরে।
এই দম্পতির একমাত্র ছেলে ঢাকায় রিকশা-ভ্যান চালান। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান লকডাউনে তিনিও বাড়ি ফিরে এসেছেন।
নাজুক চোখে তার ঘরের বর্ণনা দিতে গিয়ে বৃদ্ধ নুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিন ফাটিফুটি একেবারে ইয়া হয়া গেছে। টিন এখান উড়িও গেছি। তাও কিছু করবের পাই নেই। বেড়াও দিবের পাই নাই; টিন নাই। কলা পাতাটাতা, হাবিজাবি দিয়ে থুচি।
‘ঘরের মধ্যে থাকপের পাই না, পানি। এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করি যাই, ঘরে কুত্তেটুত্তে (কুকুর-শেয়াল) হাবিজাবি ঢোকে। দুঃখ, খুব দুঃখকষ্ট।
‘চেয়ারম্যানের কাছে যাই। তাইও কিছু ব্যবস্থা করে না। বয়স্ক ভাতার কার্ড চাই! তাইও কার্ড দেয় না। সরকার বলে মেলা মানষক (মানুষ) ঘর দেয়। হামাক তো দেয় না। ঘর চালে (চাইলে) তো টেকা (টাকা) চায়, হামি কোটে (কোথায়) পাই টেকা। নিজে খাবার পাই না। আটা খাই এনা, চিড়ে খাই এনা।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছে থেকে দেখার স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে তার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। বলেন, ‘শেখ মুজিবকে দেখছি। সাল্লেপুরে (সাদুল্লাপুর) আচ্চিল (এসেছিলেন) একবার।’
নুরুল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেননি বটে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। তার এই ঘরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিতেন। আর তিনি থাকতেন পাহারায়।
এ বিষয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বহু মুক্তিযোদ্ধা আমার বাড়িত থাকচে। হামি পহরা (পাহারা) থাকছি। তামান (সব) বাড়ি দাবড়ায় (খোঁজা) আর হামি ঘরত থুয়ে পহরা থাকছি।’
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই আশ্রয়দাতা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দিন যায় খেয়ে-না খেয়ে।
তার স্ত্রী মজিরন বেগম বলেন, ‘এই যে রোজা থাকপের নাকছি কত কষ্ট করি। হয় এনা আটা, না হয় চিড়ে আনি খাবানাকছি।’
দামোদরপুর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী সোনাতন মহন্ত বলেন, ‘নুরুল ভাইকে তো ভালো করে চিনি। হ, ভাই যুদ্ধের টাইমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সহযোগিতা করছে। তাই তো (নুরুল) সে টাইমে ধনী লোক আছিল। আজ তার করুণ দশা।’
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুর রশীদ আজমী বলেন, ‘যুদ্ধের সময় দামোদরপুর ইউনিয়নে বহু মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যে নুরুল ইসলামের কথা বলছেন, তিনি ভালো মনের মানুষ। স্কুলে জমিও দান করেছেন তিনি।
‘একাত্তরে তিনি এলাকার অনেক রাজাকারের তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তার আশ্রয়ে ছিলেন, কথাটা সত্য।’
জানতে চাইলে সাদুল্লাপুর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম স্বাধীন বলেন, নুরুল ইসলামের খাদ্যাভাব পরিষদের বরাদ্দ থেকে নিরসন করা হবে।
নুরুলের জন্ম ১৯৩২ সালে। আজও তিনি বয়স্ক ভাতার কার্ড পেলেন না কেন, জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র রায় বলেন, ‘ইতিমধ্যে তার বয়স্ক ভাতার জন্য অনলাইনে আবেদন পেয়েছি। চলতি ধাপে তিনি ভাতার কার্ড হাতে পাবেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নবীনেওয়াজ বলেন, ‘নুরুল ইসলামের বাড়ি পরিদর্শন করা হবে। যেহেতু তার জমি আছে, ঘর নেই। এই প্রকল্পের খ শ্রেণিভুক্ত ঘরের বরাদ্দ পেলে তাকে ঘর করে দেয়া হবে। এ ছাড়া তাকে দ্রুত উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।’