কয়েক দিন ধরে আলোচনার বিষয় লকডাউন নিয়ে মন্তব্য করা পথশিশু মারুফ। শনিবার কোতোয়ালি থানা-পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে আদালতের নির্দেশে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আশ্রয়ে নিয়েছে।
মারুফের মতোই পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে আশ্রয় নেয়া শিশুর সংখ্যা অন্তত ৪০। সবাই যে পরিবারহীন, ছিন্নমূল এমন নয়। এদের অনেকের পরিবার থাকলেও নেশার টানে রাস্তার জীবন বেছে নিয়েছে।
পার্কের এই শিশুরা কীভাবে, কোথা থেকে এখানে এলো, তা জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশির ভাগের পরিবারে মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হওয়া। শিশুদের কেউ কেউ মাদ্রাসায় পড়ত। পিটুনির ভয়ে বাড়ি ছেড়ে এখানে নেশার জগতে ঢুকে পড়েছে। যাকে নিয়ে এত আলোচনা, সেই মারুফের পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সৎমায়ের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সে।
ঢাকা শহরে অভিভাবকহীন এসব শিশুর খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। স্নেহের স্পর্শহীন এক রূঢ় বাস্তবতায় এরা বেড়ে ওঠে। ফলে সহজে ঝুঁকে পড়ে মাদকের নেশার দিকে। আর এ নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত হয় নিজেদের মধ্যে।
পথশিশুদের দেখভালের দায়িত্ব সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত থাকলেও তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
কিছু এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অল্প কিছু উদ্যোগ দেখা যায়, যা সীমিত থাকে মূলত খাবারের বিনিময়ে এসব শিশুর পড়াশোনার ব্যবস্থা করার মধ্যে। কিন্তু এতে কোনো ফল আসে না বলে আক্ষেপ করেন এনজিও কর্মীরা। সংগঠনগুলোর দাবি, পড়াশোনা ও খাবার দেয়া দুই-ই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খাবার দেয়া গেলেও পাঠদান মুশকিল হয়ে যায়। এরা কিছুতেই লেখাপড়া করতে রাজি হয় না।
রাজধানীর পার্কগুলোতে দেখা যায় মারুফের মতো অনেক ছিন্নমূল শিশুকে। ছবি: নিউজবাংলানেশার জগতে জড়িয়ে পড়ে কেন এরা? কীভাবে? জানতে এদেরই ৯ বছর বয়সী এক শিশুর সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা। শিশুটির গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর হলেও গত দুই বছর ধরে বাহাদুর শাহ পার্কে বসবাস তার।
পরিবার ছেড়ে এখানে কেন জানতে চাইলে তার জবাব: ‘আমার আব্বায় আমারে হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি করছিল। কিন্তু মাদ্রাসায় পড়তে আমার ভালো লাগে না। তাই মাদ্রাসা পলায়ে বাড়ি যাইতাম। যহন বাড়ি যাইতাম, সারা দিন ঘুরে রাতে বাড়ি যাইতাম। তহন আমার আব্বা-মায় আমারে পিডাইত। পরদিন সকালে আবার মাদ্রাসায় হুজুরের কাছে দিয়া আইত। সেখানে গেলে মাদ্রাসা পালানোর জন্য হুজুরে পিডাইত। কিন্তু আমি কী করুম? পড়তে ভালো লাগে না। আবার সবাই মারে। সে জন্য একদিন রাইতে লঞ্চে চড়ে ঢাকা চলে আইছিলাম। আর যাই নাই। তখন থেকেই এই পার্কে থাকি।’
এ শিশুগুলো কৃত্রিম আঠাজাতীয় একধরনের শস্তা নেশাদ্রব্য সেবন করে থাকে, যাকে এরা বলে ‘ড্যান্ডি’।
ওই শিশুটি নিউজবাংলাকে বলেছে: ‘ঢাকায় আসার পর প্রথমে কয়েক দিন লঞ্চঘাটে ছিলাম। ঘাটে যারা আইত তাদের কাছ থেকে চাইয়া (ড্যান্ডি) খাইতাম। আমার কাছে তো টাকা ছিল না। এরপর সেখান থাইকা একদিন বিকেলবেলা হাঁটতে হাঁটতে এই পার্কে আইসা দেখি, আমার মতো সবাই এগুলা খায়। অনেকক্ষণ দাঁড়ায় থাকার পর একজন কইল, ‘আয়’। তখন তার লগে পার্কের কোনার দিকে দাঁড়ায় খাইছিলাম। তখন যে খাইছিলাম, তারপর থাইকা এহনও খাই।’
এই নেশাদ্রব্যের জোগান না পেলে এসব শিশু অস্থির হয়ে নিজেদের শরীরে নিজেরাই জখম করে বলে জানা যায়।
আরেকটি শিশু এখানে এসে জুটেছে বরিশাল থেকে। তারও প্রায় একই বিবরণ। সে-ও তার এলাকার একটি হাফেজি মাদ্রাসায় পড়ত। সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ি ছাড়ে সে।
শিশুটি নিউজবাংলাকে বলে, ‘মাদ্রাসায় পড়ার সময় আমারে বাইরে ঘুরতে দিত না। মনমতো খেলমু, হ্যাউও হইতো না। আবার বাড়িতে গ্যালেও আমার মায় আবার ঠ্যাইল্যা মাদ্রাসায় পাডায়া দিত। আমার গ্যারামের সব বন্ধু ইসকুলে মজা করত আর পড়ত। আমার মায় আমারে হুজুর বানাইব বইলা মাদ্রাসায় দিছিল। পরে মাদ্রাসা পালায়া মাদ্রাসার এক বড় ভাইয়ের লগে ঢাকায় আইছি। আমার লগে যে বড় ভাই আইছিল, হ্যায় আবার সদরঘাটে কাম করে।’
এসব পথশিশুর সামাজিক সুরক্ষায় নেই যথাযথ উদ্যোগ। ছবি: সংগৃহীতওই শিশুটির দাবি, এই পার্কে আসার পর অন্য কোথাও যেতে তার মন চায় না। কেননা, এখানে এখন তার অনেক বন্ধু। সে বলে, ‘আমরা একসঙ্গে যেহানে মন চায় ঘুরি, আবার একসঙ্গে ড্যান্ডি কিইন্না ভাগাভাগি কইরা খাই।’
শিশুটি বলে, ‘আমার মনে অনেক কষ্ট। তারপরও এখানে থাকতে ভালো লাগে। আর যহন খারাপ লাগে, তহন ড্যান্ডি খাই আর কান্দি।’
আরেকটি শিশু জানায়, চার বছর আগে সে এসেছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। সে বলে, ‘আমার বাবা নাই, মা আছে। কিন্তু মায়ের সঙ্গে কথা হয় না। দেখাও হয় না। আমি ছোটবেলা থেকে নারায়ণগঞ্জ ট্রেন স্টেশনে থাকছি। তারপর ট্রেনে কইরাই ঢাকা আইছি। এরপর ঢাকার অনেক জায়গায় থাকছি। এখন পার্কে থাকি, খাই, ঘুমাই।’
তার মতো একই পরিণতি হয়েছে ১১ বছরের আরেকটি মেয়েশিশুর। বাবা-মায়ের সংসার টেকেনি বলে কোনো পরিবারের আশ্রয় পায়নি শিশুটি। তাই তার এখনকার ঘরবাড়ি এই পার্ক। এই মেয়েশিশুটিও জড়িয়েছে মাদক সেবনে।
সে নিউজবাংলাকে বলে, ‘আমাদের সবকিছুই এই পার্কে। এখানেই গোসল করি, খাই-ঘুমাই সব এখানে। কিন্তু টাকা লাগে। পার্কের মধ্যে সিটি করপোরেশনের বাথরুমে গোসল করা যায়; ১০ টাকা লাগে। টয়লেট করতে লাগে ১০ টাকা। সারা দিন চাইয়া যে ট্যাকা পাই, খাইতেই যায় গা। শুধু আমার না। এই পার্কে যত পোলাপাইন থাহে, সবাইকে এইরমভাবে চলতে হয়।
‘আমাগো তো ড্যান্ডি খাওয়ন লাগে, আপনি তো দেখছেন। ড্যান্ডির টাকা জোগাইতে বোতল- প্লাস্টিক কুড়াই।’
শিশুটি বলে, ‘মাঝেমধ্যে খুব খারাপ লাগে। তখন খুব কান্দি। আর কিছু ভালো না লাগলে ড্যান্ডি খাই আর নিজের গায়ে ব্লেড দিয়া পোঁচ দিই। দেহেন না গায়ের অবস্থা। এহন রোদ-বৃষ্টি কোনো কিছুতেই আমার কষ্ট হয় না। আমরা তো রোদ-বৃষ্টির মধ্যে ঘুমাই।’
এসব শিশুকে আশ্রয় দিতে রাষ্ট্রের কী ব্যবস্থা, জানতে ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে উপপরিচালক রুকনুল হক নিউজবাংলাকে জানান, ‘ওসব শিশুদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। আলোচনা করে জানাতে পারব।’
শিশু মারুফের বিষয়টি ভাইরাল হয়েছে বলে সে আশ্রয় পেয়েছে, কিন্তু অন্য শিশুদের আশ্রয় হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুলিশ ছাড়া রাস্তা থেকে আমরা কোনো পথশিশুকে পুনর্বাসন করার জন্য নিয়ে আসতে পারি না। তাই অন্য শিশুদের ব্যাপারে এখন কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।’