বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘বীরাঙ্গনা’ চারুবালার পঞ্চাশ বছরের যুদ্ধ

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ২৫ এপ্রিল, ২০২১ ০৯:০৫

১৯৭১ সালের ৭ মে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়নের রমেশ বালার ডাঙ্গীসহ কয়েকটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামে নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চারুবালা বিশ্বাস সে সময়ে মুখোমুখি হন ভয়াল বিভীষিকার। হানাদার বাহিনী চারুবালার স্বামী ও দুই মাসের কোলের সন্তানকে হত্যা করে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন চারুবালা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও চারুবালা পাননি আত্মত্যাগের স্বীকৃতি। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কিংবা বীরাঙ্গনার তালিকায় নাম নেই তার।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন চারুবালা বিশ্বাস। কৃষক স্বামী চন্দ্র কান্ত বিশ্বাসের মৃত্যু দেখেছেন তিনি চোখের সামনে। দুই মাস বয়সী একমাত্র কন্যাকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে হানাদাররা।

সে সময়ের কিশোরী বধূ চারুবালা আকস্মিক এমন দৃশ্যে ছিলেন হতবাক। তারপর পাকিস্তানি সেনাদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি।

জীবন থেকে সব হারিয়ে চারুবালা বিশ্বাস একাকী পাড়ি দিয়েছেন পঞ্চাশ বছর। মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, মেলেনি সহায়তা। ফরিদপুরেরর দুর্গম চরাঞ্চলে ভাইয়ের জমিতে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছেন তিনি।

৬৭ বছর বয়সী চারুবালার দৃষ্টি এখন অনেকটাই ঝাপসা, কিন্তু একাত্তরের স্মৃতি তার কাছে জ্বলজ্বলে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ মে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়নের রমেশ বালার ডাঙ্গীসহ কয়েকটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামে নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

চারুবালা সে সময়ে মুখোমুখি হন ভয়াল বিভীষিকার। হানাদার বাহিনী চারুবালার স্বামী ও দুই মাসের কোলের সন্তানকে হত্যা করে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর এ পৈশাচিকতার শিকার হয়ে চারুবালা এলাকা ছাড়েননি। পদ্মার দুর্গম চরাঞ্চলে ভাইয়ের আশ্রয়েই কাটছে তার দিনকাল।

চারুবালা বিভীষিকাময় সেই দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বামী কৃষিকাজ করতেন। বৈশাখ মাসের শেষের দিকে বাড়ির আশপাশে চারা আউশে সয়লাব হয়। দুপুরে রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

‘হঠাৎ করেই ২০/২৫ জন পাকিস্তানি সেনা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এরপর আমার স্বামীকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। প্রথম তার পায়ে পরে মাথায় গুলি লাগলে কাতরাতে কাতরাতে মারা যায় সে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাকসেনারা এরপর আমার কোলে থাকা দুই বছরের শিশু পার্বতীকে ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে আছড়ে হত্যা করে। হায়েনারা আমাকে জোরপূর্বক ঘরের মধ্যে নিয়ে একের পর এক ধর্ষণ করতে থাকে।

‘তিনজন সেনার নির্যাতন পর্যন্ত আমার জ্ঞান ছিল। রাতে জ্ঞান ফিরলে অসুস্থ অবস্থায় স্বামী ও সন্তানের মরদেহ খুঁজতে থাকি। দেখি বাড়ির এক কোণে তারা পড়ে আছে।’

জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত চারুবালা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সব হারিয়েছি আমি। আমার নিজের বলে আর কিছু নেই। থাকি ভাইয়ের জায়গায় একটা খুপরি ঘরে। স্থানীয় কয়েকজন এই জমি নিয়ে ঝামেলা করছে, হুমকি দিচ্ছে। জমিটি তারা দখল করে নিলে রাস্তায় গিয়ে থাকতে হবে।’

চারুবালার বসবাস গাজিরটেক ইউনিয়নের পদ্মা নদী থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে দুর্গম বালুচর পেরিয়ে ফসলি জমির মাঠে। ভাই সিদ্ধিচরণ সরকারের আশ্রয়ে ভাঙাচুরা ছাপরায় বসবাস করেন চারুবালা।

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে তেমন কেউ খোঁজ রাখেননি চারুবালার। শহিদ পরিবার কিংবা বীরাঙ্গনা বিবেচনায় পাননি সরকারি সুযোগসুবিধা। সম্প্রতি ফরিদপুর শহিদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির নেতৃবৃন্দ চারুবালাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। তারা চেষ্টা করছেন চারুবালার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য।

চরভদ্রাসন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার জৈনদ্দিন সিকদার বলেন, ‘যুদ্ধচলাকালীন রমেশ বালার ডাঙ্গী, বৈদ্য ডাঙ্গী, মণ্ডল ডাঙ্গী, সাতঘর ডাঙ্গী, বিন্দু ডাঙ্গী, কানাইরটেক ও হোসেনপুর গ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হায়েনারা।

‘সে সময় চারুবালা নির্যাতিত হয়েছেন। আমরা এর আগে চারুবালাকে বীরাঙ্গনা বা শহিদ পরিবার হিসেবে তালিকাভুক্তি করার সরকারি কোনো নির্দেশনা পাইনি। সম্প্রতি তাকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।’

ফরিদপুর শহিদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি শেখ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘দুর্গম চরাঞ্চলে চারুবালা অসহায়ভাবে জীবনযাপন করছেন। পঞ্চাশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন একটি খুপরি ঘরে। আমরা তাকে খুঁজে বের করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

গাজিরটেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ইয়াকুব আলী বলেন, ‘চারুবালাকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে গত পাঁচ বছর বিধবা ভাতা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অনুদান দেয়া হয়েছে।’

সম্প্রতি অসুস্থ চারুবালাকে দেখতে যান চরভদ্রাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকারিয়া হোসেন। তিনি বলেন, ‘রমেশ বালার ডাঙ্গী গ্রামে চারুবালার মতো এমন একজন মানুষ আছেন, তা জানতে পেরে সেখানে গিয়েছিলাম। তার সাথে দেখা করতে পেরে ভালো লেগেছে। চারুবালা তার ভাইয়ের জমিতে একটি ছাপরা ঘরে থাকেন। ওই জমি নিয়ে পাশের বাড়ির লোকজন ঝামেলা করছিল সেটাও সমাধান করে দিয়েছি।’

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে অত্যাচারের শিকার হন চারুবালা বিশ্বাস। বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সরেজমিন গিয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। সম্প্রতি সেই প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ চারুবালা বিশ্বাসকে নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর