জং ধরা, রং চটা, ধুলায় আচ্ছাদিত হয়ে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে যানবাহন। কোনোটির চাকা বসে গেছে। সিট নেই, দরজা নেই, গ্লাস ভাঙা, আবার কোনোটির কিছুই নেই; পড়ে আছে শুধু কাঠামো।
বছরের পর বছর ধরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) থানাগুলোতে এভাবে পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার শত শত যানবাহন।
মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা; কী নেই সেখানে? হঠাৎ দেখলে যে কারও মনে হবে, এগুলো পরিত্যক্ত গ্যারেজ কিংবা গাড়ির ভাগাড়। দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে, ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে জরাজীর্ণ হয়ে গেছে গাড়িগুলো।
ডিএমপির প্রায় সব থানার ভেতর ও বাইরের রাস্তায় বছরের পর বছর এমন দৃশ্য দেখছে রাজধানীবাসী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, আইনি জটিলতার কারণে এসব গাড়ি দীর্ঘদিন থানায় রাখতে হয়। গাড়ি বেশি হয়ে গেলে থানার ভেতরে জায়গা হয় না, তখন সেগুলো রাস্তার পাশে রাখা হয়।
রাজধানীর আদাবর, শাহবাগ, মতিঝিল, সবুজবাগ, শেরেবাংলা নগর, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী, পল্টন, মিরপুর, পল্লবী, শাহআলী থানায় এ দৃশ্য দেখা গেছে।
বংশাল থানার সামনে বিভিন্ন সময় জব্দ করা মোটরসাইকেল পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ছবি: সাইফুল ইসলাম
সংশ্লিষ্টরা জানান, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক বহন, সড়ক দুর্ঘটনা বা আইন ভাঙার কারণে আটক করা হয় এসব যানবাহন। এর মধ্যে বেশি রয়েছে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এসব গাড়ির কারণে থানাগুলো যেন এখন এক একটা ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত হয়েছে।
আদাবর থানার সামনের রাস্তায় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব যানের কারণে সেখানকার প্রধান সড়ক এখন সংকুচিত। প্রায়ই সৃষ্টি হয় যানজট। আর পড়ে থাকা গাড়িগুলোর বেশির ভাগ এখন আর ব্যবহার উপযোগী নেই। অনেক মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে গেছে।
আদাবরের মতো একই চিত্র মোহাম্মদপুর থানায়। সেখানেও কম্পাউন্ডে জায়গা না থাকায় থানার সামনের প্রধান সড়কে রাখা হয়েছে জব্দ গাড়ি। সেখানে থাকা গাড়িগুলোর কোনোটিই আর ব্যবহার উপযোগী নেই।
সেসব গাড়িতে চার লেনের সড়ক এখন সংকুচিত হয়ে তিন লেনে পরিণত হয়েছে। সামনেই রয়েছে ইউটার্ন। ফলে এখানে যানজট নিত্যসঙ্গী।
থানা চত্বরে পড়ে থেকে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়া বাস। ছবি: সাইফুল ইসলাম
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী নিউজবাংলাকে জানান, দুর্ঘটনা ছাড়াও অনেক সময় মামলার আলামত হিসেবে এসব গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। দীর্ঘদিনেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এগুলো পড়ে আছে।
দুর্ঘটনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি ফেরত নিতে মালিকদের অনীহা থাকে বলে জানান তিনি।
গাড়িগুলোর যন্ত্রপাতি চুরি হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জব্দের পর কী কী যন্ত্রপাতি আছে আমরা তার একটা লিস্ট করি। হস্তান্তরের সময় সেই লিস্ট ধরেই করা হয়।
‘তবে রোদ-বৃষ্টি, ঝড়ে বেশিরভাগ সময় এগুলোতে জং ধরে নষ্ট হয়ে যায়। চুরি তেমন একটা হয় না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আদাবর থানার এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব থানার নিজস্ব জায়গা আছে তাদের সমস্যা একটু কম। আমাদের মতো যেগুলো ভাড়াভিত্তিক তাদের রাস্তা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
‘তাই সবসময় ঠিকমতো পাহারা দেয়াও যায় না। অনেক সময় নেশাগ্রস্তরা গাড়ি থেকে যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যায়। যত দিন নিজস্ব ডাম্পিং জোন করতে না পারা যাবে, তত দিন এসব গাড়ির সঠিক নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে না।
গুলশান থানার সামনের সড়কে দীর্ঘদিন পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়ি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, থানায় যেসব গাড়ি রাখা হয়েছে তা মামলার আলামত। এগুলো আদালতের সম্পত্তি, থানার নয়। আদালতের নির্দেশে গাড়িগুলো থানায় রাখা হয়।
তিনি জানান, রাজধানীর আগারগাঁও, মিরপুর ও কাঁচপুরে তিনটি অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন আছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। তাই বাধ্য হয়েই গাড়িগুলো থানায় রাখতে হচ্ছে।
ইফতেখায়রুল বলেন, ‘চিটাগাং রোডে বেশ কিছুদিন আগে একটি স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশনের জন্য আমরা জায়গা দেখে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। সেটার এখন কী অবস্থা বলতে পারছি না। নতুন করে জায়গা খুঁজছি আমরা। পেলে সমস্যা সমাধান হবে।’