লকডাউনের মধ্যে রাজধানীতে পরিচয়পত্র প্রদর্শন নিয়ে ডাক্তার-পুলিশ বিতর্কে জড়ানো ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদের বাবা শেখ মো. আসাদুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে।
যুদ্ধের ৪০ বছর পর ২০১১ সালে নড়াইলে করা তালিকায় নাম উঠে আসাদুজ্জামানের।
গত সপ্তাহে সড়কে ডাক্তার-পুলিশ বাগ্বিতণ্ডার মধ্যে ফেসবুকে ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুরের বাবা আসাদুজ্জামানকে নিয়ে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ উল্লেখ করে লেখালেখি হচ্ছে। এই তথ্য জেনেছেন তিনিও। রেগে গিয়ে বলেছেন, যারা তাকে রাজাকার বলছে, পেলে হাড় ভেঙে দিতেন।
লকডাউন চলাকালে ১৮ এপ্রিল এলিফ্যান্ট রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসকের পরিচয়পত্র দেখাকে কেন্দ্র করে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে যান মামুনুর রশীদ।
গাড়িতে প্রতিষ্ঠানের স্টিকার, গায়ে চিকিৎসকের অ্যাপ্রোন থাকার পরও পরিচয়পত্র দরকার কি না, এই নিয়ে বিতর্ক ততক্ষণে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকারে পরিণত হয়েছে।
চিকিৎসক সাঈদা শওকত জেনির অভিযোগ, নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এ কাইয়ুম তাকে ভুয়া ডাক্তার বলেছেন। এমনকি অবৈধ যৌন ব্যবসার অভিযোগে গ্রেপ্তার শামীমা নূর পাপিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বিতর্কের এক পর্যায়ে ডা. জেনি বলতে থাকেন, তিনি বীর বিক্রমের মেয়ে। তখন ওসি কাইয়ুম বলেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধার ছেলে।
একপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট মামুন ঘটনাস্থলে এসে তিনিও বলেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
তিনজনই তার বাবার পরিচয় দেয়ার পর বিষয়টি বিতর্ক তৈরি করেছে। পরিচয় ভুয়া কি না, তা নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে।
এর মধ্যে চিকিৎসক জেনির বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি একজন খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধা, যিনি তার বীরত্বের কারণে আগে থেকেই সমাদৃত।
ওসি কাইয়ুমের বাবার বিষয়ে এখনও সেভাবে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ম্যাজিস্ট্রের মামুনের বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে নানা কথাবার্তা চলছে।
ফেসবুকে নানাজন দাবি করছেন, মামুনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা নন, উল্টো তিনি পাকিস্তানিদের দোসর ছিলেন।
তবে মামুনের বাবা শেখ আসাদুজ্জামানের বাড়ি নড়াইল ও বর্তমান ঠিকানা খুলনায় খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেছে অন্য তথ্য।
তিনি এক দশক আগে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছেন। সরকারি সুযোগসুবিধাও তিনি পাচ্ছেন।
শেখ আসাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি নড়াইল জেলার লোহাগাড়া থানার মল্লিকপুর ইউনিয়নের করফা গ্রামে। তবে তিনি খুলনা মহানগরীর বি কে মেইন রোডের পূর্ব বানিয়া খামার বড় মসজিদের পাশে বাসা করেছেন। এখন সেখানেই থাকেন।
বর্তমানে অবসরে থাকা ৭৫ বছর বয়সী শেখ আসাদুজ্জামান ছিলেন কাস্টমস কর্মকর্তা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাঈদা শওকত জেনির সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট জেনির বাগ্বিতণ্ডানিউজবাংলার সঙ্গেও কথা হয়েছে আসাদুজ্জামানের। তিনি বলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নড়াইল ৮ নম্বর সেক্টরে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমি নিজ হাতে অস্ত্র চালাইছি। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। বিএল কলেজে ছাত্রলীগ করতাম এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্য আমাকে চেনে। আমিও তাদের চিনি।’
তার দাবি, তিনি নড়াইলের লোহাগাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এটি ৮ নং সেক্টরে পড়েছে। তার কমান্ডার কে জানতে চাইলে বলেন, ‘মাসুম কমান্ডার।’
সে সময় লোহাগাড়া থানা কমান্ডার কে ছিলেন, সেটিও মনে নেই আসাদুজ্জামানের। অনেকক্ষণ ভাবার পর বলেন, ‘অনেক দিন আগের কথা তাই মনে করতে পারছি না।’
কমান্ডার ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্তমানে বিএনপি নেতা শরীফ খসরুজ্জামান।
তার কথা বললে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নাম তো সব এই বয়সে মনে রাখা সম্ভব না। শরীফ খসরু আমার ক্লাসমেট।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় ৮ নং সেক্টর ছিল কুষ্টিয়া, যশোর থেকে খুলনা সাতক্ষীরা পর্যন্ত এলাকা নিয়ে।
সেক্টরের কমান্ডার কে ছিলেন?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাবা আমার তো বয়স হয়েছে। মূল কমান্ডারের বাড়ি পাবনায়।’
এই সেক্টরের দুইজন কমান্ডার ছিলেন। প্রথমে নেতৃত্ব দেন আবু ওসমান চৌধুরী। তিনি চাঁদপুরের সন্তান। পরে নেতৃত্ব দেন এম এ মঞ্জুর। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়।
নড়াইলে জেলা ও লোহাগাড়া থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের তথ্য বলছে, মুক্তিযুদ্ধের পর যেসব তালিকা করা হয় তার কোনটিতেই (ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তা) আসাদুজ্জামানের নাম নেই।
নড়াইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার গোলাম কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে ২০১১ সালে করা খণ্ড তালিকায় তার নাম ঢুকে যায়। এ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো! কীভাবে তার নাম এই খণ্ড তালিকায় ঢুকল, কারা ঢোকাল, তা আমি জানি না।’
তাহলে মুক্তিবার্তা বা ভারতীয় তালিকায় নাম না থাকার কারণ কী, জানতে চাইলে শেখ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি তো ভারতে যাই নাই।’
নিজের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি অস্ত্র জোগান দিছি, আমি নিজেই করছি। আমি নিজে যুদ্ধ করেছি।…আমি নিজেই অস্ত্র জোগান দিয়েছি, মেজর জেনারেলের কাছে।’
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যে বা যারা আমার নামে মিথ্যা কথা বলে… তাদের বিচার দাবি করি এবং তাদের শাস্তি হোক।…যারা বলে রাজাকার, তাদের পালি আমি হাড় ভাইঙা দিতাম।
‘আমি যদি মুক্তিযোদ্ধা না হই, তাহলে বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নাই।’
ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ
রাজনৈতিক পরিচয়
শেখ মো. আসাদুজ্জামানের পরিবার বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির সঙ্গে জড়িত।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল ২ আসনে ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদের আপন বড় ভাই তিনি।
তবে শেখ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি জন্মসূত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ার সময় ছাত্রলীগ করতাম।
‘আমি ৫০ ইয়ার্স আওয়ামী লীগ করি। যত আমলা আছে, আমি সবাইকে চিনি, আমাকে সবাই চেনে।’
ম্যাজিস্ট্রের মামুনের বদলি
ওই বাগ্বিতণ্ডার ঘটনায় শেখ মামুনুর রশীদকে ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে বরিশালে বদলি করা হয়েছে। দুই দিন ধরে তাকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি ২০১৫ সালে ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশাসনে নিয়োগ পান।