মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর রাতে তেজগাঁও থানায় বিবস্ত্র করে বেদম মারধরের অভিযোগ করে ফেসবুক লাইভে এসেছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এক বিএনপি নেতা শামীম আহমেদ। তিনি বিএনপির বরগুনা কমিটিতেও আছেন।
তার দাবি, থানায় মারধরের এক পর্যায়ে হেফাজত নেতা রোজার মধ্যেই পানি খেতে চান।
তবে আদালতে তোলার পর মামুনুল বা তার আইনজীবীরা এমন কোনো অভিযোগ করেননি। বরং হেফাজত নেতা বলেছেন, তাকে যে পরিবেশে রাখা হয়েছে, সেটি ইবাদত করার জন্য উপযুক্ত নয়। তাকে যেন ইবাদত করার মতো পরিবেশে রাখা হয়।
গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আইন ভঙ্গ করতে সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করা হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিবকে গত ১৮ এপ্রিল দুপুরে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও এর উপকমিশনারের কার্যালয়ে নেয়া হলেও পরে রাখা হয় তেজগাঁও থানায়।
ওই রাতে থানা থেকে তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়। রাতে সেখানে অবস্থান করার পরদিন তোলা হয় আদালতে।
এর মধ্যে ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুলকে থানায় বেদম মারধরের অভিযোগ করেন শামীম আহমেদ। তিনি দাবি করেন, সেখানে মোট পাঁচ জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। এদের মধ্যে চার জন মামুনুলকে মারধর করেছেন। আর তাকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছেন অপর এক জন। এই ঘটনার প্রতিবাদে তিনি ঈদের পর চাকরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আদালতে পুলিশের রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করা আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মেসবাহ নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, মামুনুল হক তাদের কাছে নির্যাতনের কোনো অভিযোগ করেনি। তাই তারা আদালতেও এ নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।
হেফাজত নেতার আইনজীবী বলেন, ‘আমাদের কাছে এ রকম (নির্যাতন) কোনো অভিযোগ নাই! আর এ বিষয়ে আমরা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করি নাই। যদি নির্যাতন বিষয়ে তথ্য প্রমাণসহ কিছু পাই, সে বিষয়ে তখন দেখা যাবে।’কে এই শামীম
তিনি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাড়িটানা গ্রামের আবদুল জব্বার মুন্সির ছেলে।
পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা এলাকার একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করার পর ভর্তি হন ঢাকার গেন্ডারিয়া নেছারিয়া মাদ্রাসায়। এখান থেকে পাস করেন ফাজিল।
আবদুল জব্বার মুন্সির তিন ছেলের মধ্যে শামীম দ্বিতীয়। বড় ভাই শাহ আলম শাহীন যুক্তরাজ্যে থাকেন, ছোটভাই শাহ জালাল সাইমুন এলাকা ইট বালু সিমেন্ট ব্যবসা করেন।
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এক বিএনপি নেতা শামীম আহমেদ
২০১০ সালের শুরুর দিকে পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নে বিয়ে করেন শামীম। ওই বছরই ব্যবসা পরিচলানার জন্য ২০১০ সালে শামিমকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান বড় ভাই শাহীন। পরে দুই বছরের মধ্যে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কেও অবনতি ঘটে আর আলাদা হয়ে যান তিনি।
বিদেশে যাওয়ার ১১ বছরেও এলাকায় ফেরেননি শামীম। ১০ বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান নিয়ে চরদুয়ানী এলাকায় বাবার বাড়ি থাকেন তার স্ত্রী।রাজনৈতিক পরিচয়
বিদেশে অবস্থান করলেও ২০১৭ সালে বরগুনা জেলা বিএনপির কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়া হয় শামীমকে। তিনি বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ওলামা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা। তিনি যুক্তরাজ্য ওলামা দলের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন।তিনি বিএনপি করলেও তার বাবা জব্বার মুন্সি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, ১৯৬৩ সালে বরিশাল বিএম কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি (ভিপি) আমির হোসেন আমুর অনুসারী ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে তিনি পাথরঘাটা সদর ইউয়িনের রিলিফ কমিটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন।
২০০৮ সালে হজ পালনে যাওয়ার আগে দলীয় সকল পদ পদবী থেকে অব্যহতি নেন শামীমের বাবা। বর্তমানে তিনি পাথরঘাটা পৌরশহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস করেন।ছেলে মওলানা শামীমের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে জব্বার মুন্সি বলেন, ‘গোবরে পদ্মফুল হয়, আর আমার হয়েছে পদ্মফুলে গোবর।’
মামুনুলকে নিয়ে ভিডিও সম্পর্কে জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি দেখিনি, তবে শুনেছি হেফাজত নেতা মামুনুল হকের রিমান্ড নিয়ে নগ্ন করে নির্যাতন ও কোরআন বাথরুমে ফেলে দেয়া হয়েছে- এ রকম কথাবার্তা বলেছে।
‘সে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী আপত্তিকর নানা ধরনের কথা বলেছে, যা আমি লোকমুখে শুনেছি। শামীমের কর্মকাণ্ডে আমি বাবা হিসেবে লজ্জিত, আমার পরিবার বিব্রত।’জেলা বিএনপির সভাপতি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা যা বলছেন
মওলানা শামীমের বিষয়ে কথা হয় জেলা বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মোল্লার সঙ্গে। লাইভে এসব বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক লাইভে বিতর্কিত কথাবার্তা বলেছে শামীম, যা আমরা শুনেছি। গ্রেপ্তার হেফাজত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে সম্প্রতি শামীমের ফেসবুক লাইভটি আমি দেখিনি। যেহেতু সে লন্ডন প্রবাসে, তার ব্যবারে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’পাথরঘাটা উপেজলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাবির হোসেন বলেন, ‘২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর পর আমি জানতে পারি সেই শামীম বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকে শামীম প্রায়ই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে লাইভ বক্তব্য দিয়ে আসছেন।
‘সম্প্রতি মামুনুল হক ইস্যুতে সে বেশ কয়েকবার লাইভে সরকারবিরোধী উসকানিমূলক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে গুজব ছড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। লন্ডনে থাকায় আমরা তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারিনি।’
অনলাইনে সক্রিয়
ফেসবুকে Mowlana Shamim নামে অ্যাকাউন্ট আছে বিএনপি নেতার। সেখানে যুক্ত আছেন আড়াই হাজারের বেশি ফ্রেন্ড।
নিজের পরিচিতিতে তিনি দলীয় পরিচয় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ওলামা দল যুগ্ম আহবায়ক কেন্দ্রীয় কমিটি’ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বরগুনা জেলা বিএনপি।’
Junayet Ahmed নামের একটি ফেসবুক পেইজ পেইজ থেকে সোমবার ১১.৫৫ মিনিটে ৩২ মিনিট ৫১ সেকেন্ড লাইভ করেন মওলানা শামীম।
এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মামনুল হককে উলঙ্গ করে নির্যাতন করছে ও পবিত্র কোরআন টয়লেটে ফেলে দিয়েছে।
লাইভটি হেফাজত ও বিএনপি সমর্থিত বিভিন্ন পেইজে শেয়ার দেয়া রয়েছে। একইসাথে ইউটিউবের bd sk media নামের একটি চ্যানলে লাইভ প্রচার হয়।
এর আগে ১৮ এপ্রিল তিনি নিজের ফেসবুক প্রফাইল থেকে লাইভে সরকার পতনের হুমকি দেন। ২৮ মার্চ মওলানা শামীম প্রোফাইল থেকে আপলোড করা একটি ভিডিওতে ‘শেখ মুজিবের বাপের নাম’ হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ হাসিনার বাপের নাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ এ রকম স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এর বাইরেও তিনি একাধিকবার লাইভে সরকার, আওয়ামী লীগ, ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিরুদ্ধে নানা রকম উসকানিমূলক কথাবার্তা ছড়িয়েছেন।
মওলানা শামীমের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরটি তার বাবা জব্বার মুন্সি দিতে পারেননি। ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠালেও তিনি গ্রহণ করেননি। কমেন্টে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।